দীপাঞ্জনা মণ্ডল


ছদ্ম-বেশ অথবা দেখা না দেখার মাঝের ছিটমহল

                       

মিমিকের খোলা মুখ ভাইরাল হয়ে গেছে ইন্টারনেট জুড়ে। পাশাপাশি দুটো মুখ। দুটোই মিমিকের। একটা ক্ষতবিক্ষত, কালচে রক্ত জমাট বাঁধা, চামড়ার তলায় ও ওপরে, বিশেষচিহ্নলুপ্ত একটি মৃত মুখের আদল; অন্যটা ক্ষতবিহীন, নাকের ডানদিকে চোখের কোলঘেঁষে কালো উজ্জ্বল তিলওয়ালা-যার হদিশ জানিয়েছিল জারিনি ওর ছবির পোস্ট দেখে ইন্টারনেটে, সে মুখটা অবশ্য যান্ত্রিক অনুমানের সাহায্যে বানানো হয়েছিল। মিমিকরা আর একটু সময় পেলেই নিজেদের মুখের ছবি তুলে পোস্ট করতে পারত। কিন্তু কালো কাপড়ে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি ঢাকা একদল লোক ওদের পাড়ায় ঢুকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে ওদের। আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল ওদের মুখ। যে মুখের আড়াল সরিয়ে ওরা ওদের মতো স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চেয়েছিল। মুখগুলোকে যেমনকার তেমন সামনে আসার সুযোগ দিতে চায়নি মুখোশ-বিক্রেতারা।

 

 মানুষের লজ্জাবস্ত্র মুখোশ। বাকি সারা শরীর আঢাকা। মুখটুকুতেই যা যতটুকু লজ্জা-টজ্জা। বিভিন্ন পেশার মানুষের মুখোশ দেখলে তাদের পেশা ও সামাজিক অবস্থান অনেকটা আন্দাজ করা যায়। যেমন ছাত্ররা বেশিরভাগ স্কুলের ইউনিফর্ম অনুযায়ী গরু বা গাধার মুখোশ পরে। শিক্ষকেরা পরেন শিয়ালের মুখোশ। ডাক্তারেরা কাঠঠোকরার, জমাদারেরা কাকের, রাজনীতিবিদেরা চিল বা শকুনের মুখোশ-ই বেশিরভাগ তাদের কাজের সময়ে পরেন। কাজের সময় ছাড়া এরা অনেকেই বাড়িতে বাঘের আর বাইরে কুমীরের মুখোশ পরেন। এটা একটা মোটের ওপর ছবি। আসলে সময়, অর্থ, পারিপার্শ্বিক অনুযায়ী মুখোশ বদলে বদলে যায় আর কী। নাচ, গান, ভাস্কর্য, ছবি, কবিতা এ সব দিলে তার মান অনুযায়ী খুব ভাল ভাল মুখোশ পাওয়া যেতে পারে নিয়মমতো। কিন্তু কোনটা কতটা ভাল সেটা ঠিক করে বিক্রেতাই। সরকারের কাছে ডিলার পাওয়া কিছুসংখ্যক মানুষ মুখোশ-বিক্রেতা আর সমস্ত বিনিময়মূল্যের মানদণ্ডের নিয়ন্ত্রক। তাদের সুনজরে থাকলে অনেক খারাপ ছবি, গান, নাচ-ও সেরার সেরা মুখোশ পাবার যোগ্য হয়ে যায়। আবার ঠিক উল্টোরকমটাও ঘটে, ঘটে বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে। তাদের যোগ্যতা উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হতেই থাকে। জমে হতাশা। কেউ কেউ বিকল্পের খোঁজ করেন। কঠোরভাবে দমন করা হয় তাদের। যেমন মিমিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে দেখেছে মুখোশের বদলে মুখে সরাসরি রং মেখে বিকল্প লজ্জানিবারণের পথের অনুসন্ধানে কিছু মানুষকে সরকার রাষ্ট্রবিরোধী বলে প্রকাশ্যে মুখোশ খুলে চিরে ফালাফালা করে দিচ্ছে তাদের মুখ। মিডিয়া সেই বীভৎসতাকে প্রচার করছে এই বিকল্পের সন্ধানীদের স্বরূপ বলে, আসলে কিন্তু তা সরকারি খুরের-ই কারসাজি। মিমিক নিজের জন্য সবচেয়ে কম যতটুকু না হলেই নয় তাতেই তুষ্ট। ফলত এসব ঝঞ্ঝাট থেকে দূরে দূরে নিজের পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে পাঠক্রমের শেষে। খুঁজেছে একটা সম্মানজনক পেশা যা ওর এবং ও যার যোগ্য, আর সঙ্গে থাকবার মতো মানুষও; খুঁজতে খুঁজতে ক্রমশ বড় কঠিন ঠাঁই মনে হয়েছে পৃথিবীকে।

 

 সাতদিন ধরে টানা ঘর থেকে বেরতে পারেনি মিমিক সেবার। ওর কাছে শেষ যে পাঁঠার মুখোশটা ছিল সেটায় আর জোড়াতালি দেবার মতো অবস্থাটুকুও ছিল না। তার আগের দেড় বছর ধরে ও ওই একটা মুখোশ দিয়েই কাজ চালাচ্ছিল। ফুটপাথ থেকেই কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড। তবে খুব খারাপ ছিল না মালটা। কালো রঙটা কিছু চটা ছিল লতিয়ে পড়া বাঁ কানের দিকটায়, ওর আগের দিশি কুকুরের মুখোশ আর আধঘণ্টা আড্ডার পরিবর্তে ও কিনতে পেরেছিল এই মুখোশটা। আসলে মুখোশ না থাকলে তো ও কাজের খোঁজেও বেরতে পারবে না। মুখ ঠিক মাপে ঢাকা দেওয়া মুখোশ ছাড়া ছবি দিয়ে ও অনলাইন কোনও দরখাস্ত পাঠালেও তো তা গৃহীতই হবে না। মুখোশ অনেকটাই ঠিক করে দেয় ওর সমাজ-অর্থনৈতিক অবস্থান। যেহেতু ওর পে, ডিগ্রির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই হোক এটাই ও চায় তাই একটা মোটামুটি দেখনদারি রকমের মুখোশ কিনতেই হয়েছিল ওকে। ওর সাম্প্রতিক সিনেমা আর খেলাধুলো বিষয়ে আড্ডা দেবার মতো কিছু ছিল না, অথবা ক্লাসিকাল মিউজিক; তাই ওসব নিয়ে মিনিট পাঁচেক কথা চালালেই ও যে মুখোশটা পেয়ে যেতে পারত সেটার জন্য ওকে আধঘণ্টা সময় দিয়ে মুখোশওয়ালার বাড়ির খবর জেনে, বউ-এর সঙ্গে তার তিনবছরের পুরনো দাম্পত্যের একঘেয়েমি নিয়ে আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়ে যেতে হয়েছিল, আর দিয়ে দিতে হয়েছিল ওর আগের মুখোশ। বেশ সস্তায় ও যে পাঁঠার মুখোশ পেয়েছিল তা নিয়ে বারবার জানাতে ভোলেনি মুখোশওয়ালা।

 

 মুখ খুব সুচারুভাবে ঢাকাটা মিমিকের পৃথিবীতে আবশ্যিক জনসাধারণের জন্য। ওর বাবা-মা ওকে নাচ-গান-হাতসাফাই-এর মতো কোনও উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ করে যাবার মতো বনেদি ছিলেন না যাতে মিমিক ইচ্ছে মতন বাঘ-সিংহ-ঈগল-তিমির মতো অভিজাত মুখোশ এক ঝটকায় যে কোনও এসি শপিংমল থেকে কিনে ফেলতে পারে। ফলত ওর এই ছাব্বিশ বছর বয়স অব্দি ওর পরা সবচেয়ে দামি মুখোশ হল কিশোরবেলায় পরা এক সাদা ঘোড়ার মুখোশ। তাও ওকে ওর এক এনআরআই আত্মীয় দিয়েছিল যার একটা দু লাইনের কবিতায় একটা ইউনিকর্নের মুখোশের মতো ডিজাইনার ড্রেস পর্যন্ত হয়ে যায়। অবশ্য এটার বাইরে মিমিকের আর একটা প্রিয় মুখোশ ছিল খরগোশের। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় ওদের পাড়ার নটকোনার দোকানে ও মাসকাবারি চাল ডাল আনতে যেত বাবার সঙ্গে। কখনও বাড়তি চিনি, বিস্কুট লাগলে বাবাকে ছাড়াই যেত। টুইঙ্কল টুইঙ্কল মুখস্ত বললে আড়াইশো চিনি, বাবুরাম সাপুড়ে বললে একটা বড় মেরি বিস্কুটের প্যাকেট পেত। এক বৃষ্টির দিনে দোকানের কাকু ওকে দোকানের ভিতরে টেনে নিয়ে আলতো করে ওর মুখোশ খুলে নিয়েছিল। স্কুলফেরত মিমিক তখন গাধার মুখোশের স্কুল ইউনিফর্ম পরেছিল। লজ্জায় নুইয়ে পরেছিল ও। সাড়ে তিন বছর বয়সে স্কুলে যেতে শুরু করার পর থেকে সেদিন প্রথম ওর মা ছাড়া অন্য কেউ ওর মুখোশ খুলে সম্পূর্ণ অনাবৃত ওকে দেখেছিল। ওর গাল আর চোখ আর কপাল থেকে গরম হাতের তালু যখন জলের ভেজা ভেজা ভাব শুকিয়ে নিচ্ছিল ওর কানে আসছিল ওর নরম মাংস, টানটান কচি চামড়ার প্রশংসা। ওর মুখোশটা স্কুলব্যাগে ভরে দিয়ে ওকে একটা খরগোশের মুখোশ পরিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছিল সেই কাকু। মা দরজা খুলে অবাক হয়েছিল ওকে অন্য মুখোশে দেখে; সব শুনে বলেছিল, “আমি আর তোমার বাবা যেভাবে তোমার মুখ ছুঁই তা ছাড়া অন্যভাবে কেউ ছোঁবার চেষ্টা করলে, বা তোমার কিছু খারাপ লাগলে তুমি সেটা জানাবে তক্ষুনি। চেপে রাখবে না কিছু।বাথরুম থেকে ওকে ধুইয়ে-মুছিয়ে বের করে মা তার নিজের হাতে জোড়াতালি দিয়ে বানানো বাড়িতে পরার আলগা একটা চশমার মতো ছোট্ট মুখোশটা পরিয়ে দিয়েছিল। এতটা মুখ খোলা থাকতে অবশ্য ততদিনে আপত্তি জানাতে শুরু করেছিল বছর নয়ের মিমিক। দরজায় কেউ ডাকলে ও ছুটে গিয়ে বিছানায় মুখ লুকোতো; সেদিনের পর থেকে ও ওই খরগোশের মুখোশটা ব্যবহার করা শুরু করে বাড়িতে বাইরের কেউ এলে তার সামনে আসার জন্য। কাকুর দোকানটায় গেলেও ওটা পরত, আর কাকু মুখোশের ওপর দিয়ে ওর নাক নেড়ে ওর জিনিসের সঙ্গে ফাউ দিতেন একটা দুটো লজেন্স। মা-বাবার কথাবার্তার কিছু অংশ থেকে ও বুঝেছিল ওই কাকুর ওর বয়েসি একটা বাচ্চা তার মায়ের সঙ্গে অন্য কোথাও থাকে, তাই ওকে অমন করে আদরযত্ন করে কাকুটা।

 

   আসলে মুখোশ এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বর্তমান সভ্যতার। গাছপালা ব্যবহার করে এক পৃথিবী মানুষের জন্য ওসব পোশাক আর কাগজ বানালে যে আর বেশিদিন টিঁকতে হবে না, তা বুঝে শ-পাঁচেক বছর আগেই বর্তমান ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ। প্রথম দিকে নাকি ওইসব পোশাক আর কাগজের মুখোশ চলেছিল, তারপরে সেসব কাঁচামাল ফুরতে মানুষের চামড়া দিয়ে মুখোশ তৈরির আজকের পদ্ধতি আসে। এখন কেউ মারা গেলে তার চামড়া ছাড়িয়ে জীবাণুমুক্ত করে শুকিয়ে তার থেকে নানা মুখোশ তৈরি হয়। সেখানে মৃত পশুদের লোম আর পাখিদের পালক-ও ব্যবহার করা হয়। বাস্তব ও কল্পিত নানান প্রাণীর আদলে বানানো হয় মুখোশ। অবশ্য পৃথিবীতে মাঝারি দামের যে সব মুখোশ তারাই ঠিকঠাক মুখ ঢাকার কাজ করে। খুব বেশি আর খুব কম দামের মুখোশে মুখের অনেকটাই খোলা থেকে যায়। নিতান্ত কেজো মুখোশের বাইরে যারা ফ্যাশনেবল মুখোশ ব্যবহার করেন তারা উচ্চবিত্ত। তবে এসব সুক্ষ্ম শিল্পিত মুখোশের কমদামী নকল উঠতি বয়সের মানুষ ব্যবহার করে, তাদের গুণমান যথেষ্ট খারাপ, সেইসব মুখোশ ব্যবহার করলে ক্যান্সার পর্যন্ত হয় বলে এখন শোনা যাচ্ছে। মুখোশ বানানো সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সারা পৃথিবীতেই। সরকার এর আমদানি-রপ্তানি-ভর্তুকি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ করে বলে এর কালবাজারি, মজুতদারি সবই মাত্রাতিরিক্ত। ক্রমশ মুখোশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে; অথচ মুখোশ ছাড়া রাস্তায় বেরনো দণ্ডনীয় অপরাধ শুধু নয়, তা কোনও সভ্য মানুষের পক্ষে চরম লজ্জা ও অবমাননার-ও বটে, অভ্যেসের বশে।

 

 বড় হবার সময় মিমিক প্রথম ওর মাকেই দেখেছিল মুখোশ খোলা অবস্থায়। স্নান সেরে বেরচ্ছিল মা, হাত ফসকে বাথরুমের মেঝেতে পরে বিড়াল মুখোশ ভিজে গেছিল আর সেই খোলা মুখ ছুটির দিনের সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙা মিমিক দেখে স্থানু হয়ে গেছিল। মা তাড়াতাড়ি দু হাতে মুখ ঢেকে সরে গেছিল সামনে থেকে। অনেকদিন মায়ের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলত না মিমিক, পালিয়ে বেড়াত। তারপরে ক্রমশ স্বাভাবিক হল। একদিন পাশের বাড়ির এক বৌদিকে খোলা মুখে দেখল হঠাৎ ছাতে উঠতে গিয়ে, তাদের বাথরুমের দেয়ালের ফোকর দিয়ে। অমন নির্মেদ কোমরের, রোমহীন চামড়ার বউদির চোখের তলার কালি দেখে কেমন গা ঘুলিয়ে উঠল ওর। প্রথমবার সমস্ত খোলা সুন্দরের আড়ালে লুকোনো কুৎসিত সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিঘাত পেল ও। তারপরে অনেককেই দেখছে, মুখোশ উন্মুক্ত অবস্থায়; পেশল স্বাস্থ্যের চোখে কোমলতা, পৃথুলার টানটান নাক-ঠোঁট-থুতনি- এরকম বৈপরীত্য আবার প্রত্যাশিত সুন্দরের অথবা অসুন্দরের শরীর ও মুখের মেলবন্ধন, অভিজ্ঞতা ওকে পরিণত করেছে অভিঘাত সইতে।

 

  বয়স বাড়তে ও ছেড়েছে ওর জন্মস্থান, বাবা-মা ছেড়ে গেছেন ওকে। তাদের চামড়ার বিনিময়ে ও একটা খুপরি ঘর জুটিয়েছে ওর বর্তমান শহরের প্রান্তে। এর মধ্যে এক বিশেষ বন্ধু হয়েছে ওর, জারিনি, ছিপছিপে হলদে কালো ছোপের বেড়ালের মুখোশ পরা। দুজনে দেখেছে মুখোশ খুলে দুজনকেই। ওর মায়ের হাতের সেই ভিজে যাওয়া বিড়াল মুখোশের কথা মনে পড়েছে ওর। জারিনির সঙ্গে থাকতে থাকতেই ও শিখেছে মুখোশের নিচে থাকা মুখের যত্ন নিতে, দেখা যায় বলে শরীরের বাকি অংশের সৌন্দর্যচর্চা করা হয়েই থাকে। অথচ ঢাকা থাকে বলে ঠোঁটের কষের, নাকের সিকনি অথবা চোখের কোণের পিঁচুটি নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই তেমন পরিচর্যা করে না। ফলত আলো পিছলে যাওয়া একটা গোটা শরীরের আড়ালের মুখ যে কতোটা বিপ্রতীপ ময়লাটে হতে পারে আর তার ধাক্কা কতোটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে সহবাসীর মনে তা নিয়ে অনেকেই সচেতন নয়। জারিনির শান্ত ধৈর্য এসব খুব স্পষ্ট করেছিল মিমিকের কাছে। অবশ্য ও নিজে বা জারিনি দুজনেই এই পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দিতেই শিখেছিল বড় হবার সময়ে, আর তা নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনেই।

 

এই একসঙ্গে থাকাথাকির সময়ে ক্রমশ সঞ্চয় ফুরিয়েছে। মুখোশের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ওর। ফলত ওর মোটের ওপর আকর্ষক শরীরের আবেদন ওই যথাযথ রুচিশীল, বুদ্ধিদীপ্ত মুখোশের অভাবে যথাযোগ্য উচ্চতায় পৌঁছয়নি, না সমাজে না পেশাগত জায়গায়। বিড়াল মুখোশের মানুষ এক অ্যালসেশিয়ান মুখোশধারীর সঙ্গে থাকতে গেছে। মিমিক বদলে নিয়েছে ওর রোডেশিয়ানের মুখোশ ছাগলের সঙ্গে। কখনো বাচ্চাদের কবিতা পড়িয়ে তো কখনো নতুন শহরের বন্ধুদের ওর নিজের গল্প শুনিয়ে দিন গুজরান করেছে ও। উপোস দিয়েছে টুকটাক। দেখেছে ওর মতো কাতারে কাতারে চলনসই স্বাস্থ্যের মানুষকে ছাগুলে মুখোশে। বুঝেছে ওই সস্তার মুখোশের আড়ালে সব্বাই শুকনো ঠোঁট আর ভেজা চোখ নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে।

 অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অসামাজিক কাজ বাড়ছে। রাস্তাঘাটে প্রায় সবাই সামনের বা পাশের জনের দিকে সারা শরীরের পেশি শক্ত করে নিয়ে তাকায়। নিজের শেষ মুখোশটাকে বহু যত্নে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে ও। ওটা ছাড়া ও যে কারোরই সামনে বেরতে পারবে না! তবু দিন সাতেক আগেই বেশ রাতের দিকে ও যখন ওর শেষ অণুগল্পটা শুনিয়ে দুটো বাসি রুটি আর একটু মিষ্টির রস নিয়ে ফিরছিল, কেউ একটা হ্যাঁচকা টান মারল ওর মুখোশটায়। উন্মুক্ততার লজ্জার থেকেও অনেক বেশি মুখোশ খোয়াবার ভয়ে ও ধস্তাধস্তি শুরু করল, পুরনো মুখোশটা ওর হাতে রয়ে গেলেও ছিঁড়ে গেল অনেকটাই। মুখে সেটা চেপে ধরে কোনোক্রমে ঘরে ফিরে দেখল ওটার ডান গালের কিছুটা অংশ নেই। জেগে বসে রইল। মোটামুটি পাড়াটা নিঝুম বুঝে আবার ফেলে আসা রাস্তাটুকু আঁতিপাঁতি খুঁজেও সেই ছেঁড়া টুকরো আর পেল না। সেদিন থেকেই ঘরবন্দি ও। রাতে লোডশেডিং হয় কম। হলেও এত বেশি রাতে যে প্রায় খাবার দোকান বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে বসে বসে একটা সনেট আর দুটো শোকগাথা বানিয়ে ফেলেও ওকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে প্রথম দুদিন, ওই মুখোশের অভাবে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে পাশের ঘরের আধবুড়োটাকেই একটা মুখোশ ধার চেয়েছিল ও, সনেটটা বন্ধক রেখে। কিন্তু লোকটা রাজি হল না ধার দিতে। বদলে লোকটা ওই সনেটটা দিয়ে পুরনো মুখোশটা সারিয়ে আনতে চেষ্টা করেছিল নিজের আগ্রহে, হয়নি তাও, জানিয়েছিল মিমিককে। মিমিকর হাড় বেরনো শরীরটা দেখে চুকচুক শব্দ করেছিল লোকটা। আর ছেঁড়া মুখোশটা ভেদ করে যেন চেটে নিতে চাইছিল ওর মুখ, চোখ দিয়ে। মিমিকের সামনে নির্লজ্জের মতো মুখোশ খুলে ফেলে লোকটা, কফ জড়ানো গলায় বলে মুখোশ যথাসম্ভব কম ব্যবহার করে তাকে বেশিদিন চালানোর চেষ্টা বুদ্ধিমানের কাজ। তারপরে তৃতীয় উপোসের রাতেই মিমিকর মুখোশের ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল গলাতে চেষ্টা করতেই ঘিনঘিনে অনুভুতি নিয়ে নিজের ঘরে পালিয়ে এল সে লোকটাকে ঠেলে। উচ্চকিত জানাতে পারলো না ওর খারাপ লাগা, মায়ের পরামর্শ মতো। তাতে যদি অন্যরা এসে ওর খোলা মুখ দেখে ফেলত! কোথায় আর দাঁড়াতে পারত ও, আত্মহত্যা ছাড়া অন্য পথ থাকতো না যে!

 

 সেদিন রাতে দরজায় টোকা শুনে সিঁটিয়ে যেতে যেতে ও উল্টোদিকের ঘরের কলেজ পড়ুয়ার চাপা গলা শুনেছিল। দরজা খুলতে সে ভেতরে এসে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জানিয়েছিল, যেহেতু মুখোশ দিয়ে মুখ ঢাকা পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের কাছেই বিলাসিতা, তাই ওরা মাটি থেকে, বালি আর কাঁকড় থেকে রং ছেনে মুখ আড়াল করছে। মিমিক যোগ দিতে পারে তাদের সঙ্গে। চমকে উঠেছিল মিমিক। এরা সারা পৃথিবীর সমস্ত সরকারি অস্ত্রের লক্ষ্য। এরা প্রচলিত নিয়মকে উল্টেপাল্টে দিতে চায়। ভীত মিমিকের সামনে দুটো রুটি রেখে চলে গেছিল ছেলেটি। আর আসেনি। তারপরে টানা চার দিন না খাওয়া মিমিক মনস্থির করে, মধ্যরাতে কলেজ পড়ুয়ার ঘরে যায়। নিজের নাম জানাতে খুলে যায় দরজা। ছেঁড়া মুখোশের ভেতর থেকে মিমিক দেখে ঘরে গাদাগাদি করে বসে জনা দশবারো নানা বয়সের মানুষ। সবার মুখ খোলা। অথচ তারা হাতে হাত, অথবা বুকে বা কোলে মাথা রেখে এলিয়ে শুয়েবসে আছে। কিছুই অস্বাভাবিক, পীড়াদায়ক দেখাচ্ছে না। সামনে একটা ইজেলে নানান রং। আর সেই রঙে আঙুল ডুবিয়ে ওরা আলতো বিলি কাটছে এর ওর তার মুখে। কেউ গান গাইছে, কেউ আঁকছে ছবি। সে সব দিয়ে অনায়াসে কেনা যায় অভিজাত মুখোশ। যেমন খুশি সাজা যায়। অথচ অন্যের আঙুলের স্পর্শে ওরা সেজে উঠছে একটু একটু করে। মিমিক আস্তে আস্তে নগ্ন করে নিজের মুখ। তারপরে দু হাতের আঙুল ডুবিয়ে দেয় রঙের শরীরে। আশপাশের মানুষগুলোর মতো কখনো নিজের কখনো অন্যের মুখে আঙুল বুলিয়ে দিতে থাকে। ওদের নিজস্ব আদলে অদ্ভুত অন্য প্রকাশমান হয় ওরা।

 

 ওদের এরকম থাকাথাকি সংবিধান বহির্ভূত, আর তা নিয়ে ওদের ঘরের বাইরে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে যায় কয়েকটা নেকড়ের মুখোশ পরা নিয়মরক্ষকমিমিক জানলার আড়াল রেখে দেখতে পায়, ওর পাশের ঘরের আধবুড়োটা ওর পুরনো দেশি কুকুরের মুখোশটা পরেছে আর এই নিয়মরক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে চাপা গলায়। ও কিছুতেই সেই মুখোশওয়ালার শরীরটা স্পষ্ট মনে করতে পারেনা, যে ওকে ছাগলের মুখোশটা বেচেছিল। কিন্তু একগাদা সন্দেহ ওর ভেতরের, একটা দিশা পেতে থাকে। হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তে দেখে ওর কপালের মাঝখানে একটা লালচে চোখের আদল। ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে ওর সঙ্গীরা। মিমিকরা ঠিক করে এই রাঙা হয়েই ওরা বেরোবে প্রকাশ্যে। একা নয়, দলবেঁধে। প্রথম দিন বেড়িয়ে ওরা বুঝেছিল ওদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি নয় বাকি বেশিরভাগ মানুষ। নেকড়ের কিছু মুখোশ ওদের আশপাশে চক্কর কেটে আর শূন্যে চাবুক আছড়ে চলে গেছিল। মুখোশের দাম কিন্তু কমেনি। ফলত অনেকেই দরজা বন্ধ করে পেটে কিল মেরে পরে থাকছিল। ক্রমশ খিদে যত অসহ্য হল, মিমিকদের সঙ্গে এল মানুষ। সুতরাং নেকড়েদের চাবুক পড়ল সারা শরীরে আর মুখেও। মাটির রঙ আর রক্ত মিশে গেল। শরীরের সঙ্গে মানুষগুলোকে মিলিয়ে পরিচিত করাবার অবস্থাও ছিল না। মিমিকের যে মুখের আদল তৈরি করে তার এখনকার পরিণতির পাশাপাশি সেঁটে পোস্ট করা হয়, তার থেকেই জারিনি ওই তিলের না থাকার কথা জানায়। নিখুঁত মুখ পাওয়া যায় মিমিকের। একটা পূর্ণ পরিচিতি প্রচারিত হয়। জারিনি ঠিক করে বাচ্চাদের স্কুলে আর বরকে অফিসে পাঠিয়ে ও মিমিকের নামে আসা সমস্ত গান, গল্প, কবিতা, ছবি, নাচ আর হাতসাফাই জমা করে প্রচুর মুখোশ কিনে বিলিয়ে দেবে মুখোশ কিনতে অপারগদের মধ্যে। মিমিকের নামে এই কাজ তাকে অমর করে দেবে, নিজে যে অমর হতে চায়না ও সেটাও অস্পষ্ট থাকবে না, যতদিন থাকবে মিমিকের নামের স্মৃতি! নিজের পরিকল্পনায় তৎগত জারিনির চোখের কোল ভিজে ওঠে, মুখোশের আড়ালে ওর চোখের জলের সঙ্গে শক্ত চোয়াল গোপন থাকে, যার কাঠিন্যে ওর সমস্ত আত্মত্যাগের অন্য অন্য ব্যাখ্যার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ও। মিমিকদের ঘরের থেকে প্রথমেই সমস্ত রঙের জঞ্জাল সাফ করতে হবে, সময় নষ্ট না করে কাজে নামার মানসিক প্রস্তুতি নেয় জারিনি। মিমিকের রং ফিকে হতে থাকে। কিংবা জমা হতে থাকে কোনও পয়ঃপ্রণালির প্রান্তে, আবার মাটিতে মিশে রং ছড়াবে বলে।

 

3 comments:

  1. Dipanjana r golpo ta porlam...r adbhut ekta confusion ghor o mukhos er kachha kachhi ese bose thaklam..asadharan lekha bhai..khub parinoto lekha...subject ta simple..illustration ta sotty apurbo...e lekha ta pore bhoja jai..dipanjana kau nijeke kromagoto mimic er jaigay bosie question kore palta prasna kore aste aste egiegachhe...sabdo gulo tai eto sahaj illusion create korte perechhe...darun dipanjana...next lekhar dike mukhhie thaklam...

    ReplyDelete
  2. bhalo laga jene bhalo laglo. shobder pashe shobdo rakha chhara r kichhui parini temon. abaro sei chesta korbo :)

    ReplyDelete
  3. ভয়ংকর। আশ্চর্য হয়ে গেলুম একটানা পড়ে।

    ReplyDelete