চেরনোবিলের
কণ্ঠস্বর: একটি পারমাণবিক দূর্ঘটনার কথ্য ইতিহাস
স্ভেৎলানা আলেস্কেইভিচ
রুশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ ও ভূমিকা: কিথ গেসেন
বাংলায় ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী
স্ভেৎলানা আলেক্সেইভিচ
প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের উক্রাইনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং
মিনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেন। ২০১৫ সালে সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
মিনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেন। ২০১৫ সালে সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
মূল রুশ থেকে ইংরেজিতে
(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এই বইটি অনুবাদ করেছেন কিথ গেসেন। তিনি নং+১ পত্রিকার
সম্পাদক। ‘দ্য আটলান্টিক এ্যান্ড দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ
বুকস’-এ তিনি নিয়মিত রাশিয়া বিষয়ে লেখালিখি করতেন। বর্তমানে
তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে বাস করেন।
অনুবাদকের
ভূমিকা:
২০০১-এর ২রা
সেপ্টেম্বর বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) প্রথম একটি ছিনতাইকৃত
বিমান বিধ্বস্ত হবার পর গোটা নিউইয়র্ক শহরে অনেকগুলো জরুরি সেবা প্রদান স্টেশন
খোলা হয়। ডাক্তার এবং নার্সরা হাসপাতালগুলোয় বাড়তি শিফটে কাজ করতে ছুটলেন আর বহু
মানুষ এগিয়ে এলেন রক্তদানের জন্য। এসবই ছিল উদারতা এবং সংহতির মর্মস্পর্শী কাজ।
তবে দ্রুতই দেখা গেল যে এতগুলো রক্ত দান এবং জরুরি সেবা প্রদান কেন্দ্র না খুললেও
চলতো। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দু’টো মিনার বা টাওয়ার ধসে এত বেশি মানুষ প্রাণ হারায় যে ধ্বংসের পর বেঁচে
ছিল খুবই কম সংখ্যক প্রাণ।
অথচ ১৯৮৬ সালে
চেরনোবিল বিদ্যুত প্লান্টে বিষ্ফোরণ এবং পারমানবিক আগুন সৃষ্টি হওয়ার ক্ষতিকর
পরিণতি ছিল টুইন টাওয়ার ঘটনার একদম উল্টো। শুরুতে বিষ্ফোরণে মাত্র একজন প্লান্ট
শ্রমিক মারা যায়। তার নাম ছিল ভালেরি খোদোমচুক। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে তীব্র
পারমাণবিক বিকীরণ বিষক্রিয়ায় ত্রিশ জনের কাছাকাছি সংখ্যক শ্রমিক এবং ফায়ারম্যান মারা
যায়। কিন্ত পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার বিকীরণে পরবর্তীতে দেখা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে
ভুগতে- এটা ছিল একটি দূর্ঘটনা যাতে যত যত না মানুষ মরেছে তার চেয়ে বেশি বেঁচে
থেকেছে নানা ধরণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আর এই বইটি তাদের নিয়েই।
এই বইয়ে
সংগৃহীত অনেক কিছুই আপাত:দৃষ্টে অশ্লীল মনে হতে পারে। প্রথম আলাপচারিতায় ল্যুডমিলা
ইগনাতেঙ্কো, এক ফায়ারম্যানের
স্ত্রী তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। দূর্ঘটনার পর এই ফায়ারম্যানই প্রথম চেরনোবিলের
পারমাণবিক রিএ্যাক্টর বা চুল্লীর কাছে তার বাহিনী নিয়ে যায়। তিনি আমাদের জানান
মৃত্যুর আগে তাঁর জীবনসঙ্গীর দেহের ত্বক কিভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে। গোটা
প্রক্রিয়াটি এত অস্বাভাবিক যে আমাদের যেন তেমন কিছু আর কখনো দেখতে না হয়। ‘বিছানায় এতটুকু ভাঁজে তার শরীরে ক্ষতস্থান তৈরি হয়ে যেত,’ ল্যুডমিলা বলেন, ‘আমি আমার নখ এত ছোট করে কাটতাম
যতক্ষণ না রক্ত বের হয়ে আসে। কারণ নখ এতটুকু বড় থাকলে তাকে ছুঁতে গেলে সেই সামান্য
ছোঁয়ায় তার শরীর থেকে রক্ত বের হতো।’
এই বইয়ের কিছু
আলাপচারিতা সত্যি যেন বিভীষিকা জাগায়। ভিক্টর ভার্ঝিকোভস্কি,
খোয়িনিকি স্বেচ্ছাসেবক শিকারী ও জেলে সমিতির প্রধান, বিষ্ফোরণের কয়েক মাস পর আঞ্চলিক পার্টি অফিসের নেতাদের সাথে তাঁর
সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেন। পার্টির নেতারা তাদের কাছে ব্যখ্যা করেছিলেন যে ‘বিচ্ছিন্নতা বলয়’ অর্থাৎ দূর্ঘটনার পর চেরনোবিল
বিদ্যুৎ প্লান্টের ত্রিশ কিলোমিটার এলাকাকে যে নামে সোভিয়েতরা ডাকতো- সেই গোটা
এলাকার সব মানুষকে জায়গা খালি করে দিতে হয়েছিল। তবে দূর্ঘটনার পরও সেখানে অনেক
গৃহপালিত পশু ছিল। কিন্ত গৃহপালিত এসব কুকুর বা বিড়ালের লোম প্রচুর তেজষ্ক্রিয়
উপাদান শুষে নেয় এবং মাঝে মাঝেই তারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশিত এলাকার বাইরে না বুঝেই
ঘোরা-ফেরা করতো। তখন কর্তৃপক্ষের আদেশে শিকারীদের সেখানে গিয়ে সেসব রেডিও
এ্যাক্টিভ হয়ে যাওয়া কুকুর বিড়ালকে গুলি করে মেরে ফেলতে হতো। আরো কিছু মানবিক
বিবরণী থেকে দেখা যায় যে দূর্ঘটনার পর এই বলয়ে গোটা এলাকার প্রাকৃতিক
ল্যান্ডস্কেপে পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তা নিষ্ক্রিয় করার জন্য কিছু অদ্ভুত কার্যকলাপ
হাতে নেয়া হয়েছিল- যেমন মাটি, গাছ, ঘর-বাড়ি
আমূল উপড়ে ফেলে বা খোঁড়াখুঁড়ি করে সেগুলো এলোপাতাড়ি যেন বা পারমাণবিক বর্জ্য
হিসেবে পুনরায় মাটি চাপা দেয়া। এতে খানিকটা সেই গোগোলিয় অনুভূতি হয়: সাধারণ সব
দৈনন্দিন মানবীয় কাজ আজ হয়ে উঠেছে পাগলাটে আর নিয়ন্ত্রণহীন!
সবশেষে এসব
সাক্ষ্যগাথার দৈনিন্দন আটপৌরে ভাবটাই তাদের পরিণত করে এক অমূল্য মানবিক দলিলে। ‘আমি জানি আপনারা কৌতূহলী,’ আর্কাদি ফিলিন নামে
চেরনোবিল দূর্ঘটনার পর একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী দলের সসদ্য বলেন, ‘যারা দূর্ঘটনা এলাকা ও এর আশপাশের স্থলে ছিল না, তারা
প্রত্যেকেই আমাদের বিষয়ে সব সময় কৌতূহলী। তবু দূর্ঘনার পরও আমাদের জগতটা মানুষ
দিয়েই ভরা ছিল। পুরুষেরা ভদকা খেত। তারা তাস খেলত আর মেয়েদের মন পাবার চেষ্টা
করতো।’ কিম্বা আর একজন শিকারীর কথায়: ‘তুমি
যখন তোমার জিপ গাড়ি একটি কচ্ছপের উপর চালিয়ে যাচ্ছ তখন কচ্ছপটি দেখা যাচ্ছে খোল
শক্ত করে আছে। দেখা যাচ্ছে এটা ভাঙ্গে নি বা ফাটে নি। নিশ্চয় এমনটা আমরা তখনি
করেছি বা বা করতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে যখন আমরা ছিলাম আসলে প্রচুর মদ খেয়ে মাতাল।’
সবচেয়ে ভয়ানক সব কেস-স্টাডি যাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে তারাও ছিল ‘মানুষের জগতের’ই অংশ, অংশ সেই
মানুষদের উদ্বিগ্নতার ভুবনের। ‘আমি যখন মারা যাব,’ ভ্যালেন্টিনা প্যানাসেভিচের স্বামী, তিনি নিজেও
ছিলেন দূর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্থ পারমাণবিক বিদ্যুত স্টেশনের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী,
কয়েক বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় তাঁর
স্ত্রীকে বললেন, ‘আমি যখন মারা যাব, তখন
গাড়ি আর এর বেঁচে যাওয়া টায়ারগুলো বিক্রি করে দিও। আর টল্লিককে বিয়ে করো না।’
টল্লিক তাঁর স্বামীর ভাই। না, ভ্যালেন্টিনা
তাকে বিয়ে করেন নি।
স্ভেৎলানা আলেক্সেইভিচ
এই সাক্ষাৎকারগুলো রেকর্ড করেন ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে মাঝ অবধি। যখন কমিউনিজম
বিরোধী মতবাদ সোভিয়েত উত্তর রাজনৈতিক ভাবনা-চিন্তার পরিসরে তখনো পর্যন্ত কিছু
মান্যতা পেত।
তবে একথা
অস্বীকার করা যাবে না চেরনোবিল দূর্ঘটনা কেউ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে না ঘটালেও এটা ছিল
স্বজনপ্রীতি, অলসতা এবং সাধারণ
মানুষের প্রতি ভয়ানক নির্বিকারত্বের সংস্কৃতির ফলাফল। পরবর্তী সময়ে চেরনোবিল
সম্পর্কে প্রাপ্ত সব বই-পত্র থেকে একথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রমাণিত যে এই পারমাণবিক
স্টেশনে একটি খুবই অনাধুনিক প্রযুক্তির চুল্লী কেনা হয়েছিল এবং একদল অদক্ষ মানুষকে
নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এটার দেখভাল করতে। এরপর বইটি যত অগ্রসর হয় ততই এই গ্রন্থে
গ্রথিত নানা কথ্য ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে দূর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ দূর্ঘটনা
সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে রীতিমত অপরাধীর মত নানা মিথ্যা কথা বলেছে। প্রথম সেই
সঙ্কটকালীন দশ দিনে যখন পরমাণু চুল্লীর মূল অংশ পুড়ছিল এবং চারপাশের এলাকায় উচ্চ
পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তা সম্পন্ন নানা উপাদানের ধোঁয়া নির্গলিত হচ্ছিল, কর্তৃপক্ষ তখনো বারবার বলছিল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণাধীন। ‘আমি যদি জানতাম যে সারা অসুস্থ হয়ে পড়বে, তবে আমি
বাড়ির সব দরজা আটকে রাখতাম,’ লেখক আলেক্সেইভিচকে বলেন
চেরনোবিল ঘটনায় নিহত এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বিধবা স্ত্রী, ‘আমি
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের যত তালা ছিল সব তালা দিয়ে দরজা আটকে রাখতাম।’
কিন্ত সেই সময় কেউ কিছু জানত না।
তবে তারপরও
নানা স্বাক্ষ্য থেকে একথাও পরিষ্কার যে বিষয়টা ঠিক এমনও ছিল না যে সোভিয়েতরা
চেরনোবিলকে শুধু শুধু পুড়তে দিয়েছে। সেটাও কিন্ত আমাদের মনে রাখা দরকার। একদিক
থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ অদক্ষতা, নির্লিপ্তি এবং সর্বৈব মিথ্যার বেসাতি। অন্যদিকে দূর্ঘটনার পরের ক্ষয়ক্ষতি
নিরসনের একটি প্রাণান্ত প্রয়াসও ছিল। দূর্ঘটনার পরের সপ্তাহে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ
একদিকে গোটা বিশ্বের কাছে অস্বীকার করছিল যে ভয়ানক কোন ঘটনা ঘটেছে, অন্যদিকে চেরনোবিলের চারপাশের লাখ লাখ অধিবাসীকে এলাকা ছাড়া করছিল আর
অন্যদিকে হাজার হাজার পুরুষকে নামিয়ে দেয় দূর্ঘটনা কবলিত এলাকায় উদ্ধার কাজে।
হেলিকপ্টারের খোলা দরজা থেকে জ্বলন্ত পরমাণু চুল্লীর আগুনে এই পুরুষেরা ছুঁড়ে
মেরেছে বস্তা বস্তা বালু (বিশ্লেষকরা মনে করেন এতে উপকারের থেকে অপকারই হয়েছে
বেশি)। আগুন যখন থামলো, তখন তারা পারমাণবিক স্টেশনের ছাদে
উঠে সব তেজষ্ক্রিয় জঞ্জাল পরিষ্কার করেছে। উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য তারা যে
যন্ত্র-পাতি তাদের সাথে বয়ে এনেছিল সেগুলো পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার বিকীরণে ভেঙ্গে
পড়ে। কিন্ত মানুষ ত’ কয়েক সপ্তাহ বা মাসে ভেঙ্গে পড়ার মত কোন
বস্ত নয়, তারা একটা সময় ভয়ানক ভাবে মরেছে। পারমাণবিক
তেজষ্ক্রিয়তায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মরেছে। ১৯৮৬ সালে সোভিয়েতরা একটি বিষ্ফোরিত
পারমাণবিক চুল্লীর সামনে একদল প্রশিক্ষণহীন ও অনিরাপদ যুবক পুরুষকে তারা ঠিক
সেভাবেই ছেড়ে দেয় যেভাবে ১৯৪১ সালে একদল অপ্রশিক্ষিত ও নিরস্ত্র যুবককে তারা
ভেরমাখটের রণাঙ্গনে ছেড়ে দিয়েছিল খানিকটা এই ভরসাতে যে নিরস্ত্র এই যুবকদের গুলি
করতে করতে জার্মানরা একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবে। এবং চেরনোবিল যাদুঘরের কিউরেটর যেমন
ব্যখ্যা করেন যে এই প্রচেষ্টা যদি না নেওয়া হতো, তবে এই
দূর্যোগের পরিস্থিতি আরো অনেক ভয়াবহ হতো।
১৯৯৬ সাল,
যখন এই কথ্য ইতিহাসগুলো নথিবদ্ধ করা হয়েছিল, সেসময়
থেকে বিশ্ব পরিস্থিতি আজ অনেকটাই বদলে গেছে। বেলারুশে অবশ্য পরিস্থিতি অত বেশি
বদলায় নি। ‘দ্য হেগে’ আন্তর্জাতিক আদালতের
কাঠগড়ায় যখন স্লোবোদান মিলোসেভিচ দাঁড়ানো, তখন বেলারুশের
আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কা ইউরোপের সবচেয়ে কঠোর একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত। এখন তিনি
ইউরোপের সবচেয়ে শক্ত একনায়ক যিনি চতুর্থবারের মত রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। তাঁর
সময়ে বিরোধী দলের রাজনীতিকরা সবচেয়ে বেশি ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাচ্ছে। যদিও সাধারণত: ইউরোপীয়ান সব বিরোধিতার মুখে বধির থেকেছেন
লুকাশেঙ্কো, তবু ২০০৫-এর আগস্টে বিজ্ঞানী ইউরি
বন্দাজহেভস্কিকে তিনি মুক্তি দেন। যাকে ১৯৯৯ সালে বন্দী করা হয়েছিল মূলত: এই
অপরাধে যে অতীতে যতটা না বোঝা গেছে তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি ক্ষতিকর প্রভাব
প্রতিবেশের উপর ফেলেছে চেরনোবিল দূর্ঘটনা- বিশেষত: শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর- এমন
গবেষণা প্রতিবেদন তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এটা প্রকাশ করার পরই তিনি কারারুদ্ধ হন।
বান্দাঝেভস্কি এবং তার পুরণো বন্ধু ও সহকর্মী ভাসিলি নেস্তেরেঙ্কো (২০৫ পৃষ্ঠায়
তাঁর সাথে আলাপচারিতা নথিবদ্ধ হয়েছে) বলছেন যে চেরনোবিল দূর্ঘটনার পরবর্তী
প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা হয় নি এবং সম্পূর্ণ বিপদ এখনো কাটে নি।
তাদের কথা শোনা
হচ্ছে না। ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ প্রদত্ত একটি প্রতিবেদনে ‘মাল্টি-এজেন্সী চেরনোবিল ফোরাম’-এর বরাত দিয়ে বলা হয়
যে গোটা চেরনোবিল দূর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজারের মত- এই চার হাজার
মানুষের অধিকাংশই হলো আশপাশের এলাকার অধিবাসী এবং ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’
যারা বিষ্ফোরিত পারমাণবিক চুল্লীর আগুনে প্রথম কয়েকদিন ভয়ানক
মাত্রার তেজষ্ক্রিয়তার শিকার হয়। প্রতিবেদনটির শুরুতে অবশ্য আনন্দের সাথে জানানো
হয় যে তেজষ্ক্রিয়তা জনিত কারণে থাইরয়েড ক্যান্সারে ভোগা কয়েক হাজার শিশু সুস্থ
হয়েছে। কিন্ত এ প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে নাগরিকদের কি কি ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা
দিতে পারে সেটা বলা হয় নি। মূলত: আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির তত্ত্বাবধানে
সম্পাদিত বৈজ্ঞানিক কাজের উপর প্রাথমিক ভাবে ভিত্তি করে এই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
যদিও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির চেরনোবিল সংক্রান্ত ট্র্যাক
রেকর্ড একদমই ভাল নয়। ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি গোটা
দূর্ঘটনার দায় অপারেটরের ভুলের উপর চাপিয়ে দেয়;
এই পরমাণু প্ল্যান্টের নক্সাই যে ভয়ানক ত্রুটিপূর্ণ ছিল যা প্রায়
অপরাধের সমতূল্য তা’ জানা যায় শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের
পতনের পর। গোটা প্রতিবেদনের কোথাও বান্দাঝেভস্কি বা নেস্তেরেঙ্কোর কাজের কথা
উল্লেখ করা হয়নি, স্বীকার করা হয় নি যে বেলারুশ একটি পুলিশী
রাষ্ট্র। অবিশ্বাস্য শোনালেও এই প্রতিবেদনে চেরনোবিল সংক্রান্ত যাবতীয় অসুস্থতার
কারণ হিসেবে দূর্ঘটনার পরপর এলাকার চারপাশের অধিবাসীদের কর্তৃপক্ষের নির্দেশে
ব্যপক স্থানান্তর করাকে দায়ী করা হয়েছে। অবিশ্বাস্য ভাবে এই প্রতিবেদনে মত ব্যক্ত
করা হয় যে চেরনোবিলের বর্তমান অধিবাসীদের মূল সমস্যা হলো গভীর হতাশা। অথচ
পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তায় ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্থ কৃষিজমিতে ফিরে আবাদের ভয়ানক পরিকল্পনা
হাতে নেওয়া হচ্ছে আর শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আপনিও হতাশ হবেন বৈকি।
-কিথ গেসেন, ২০০৫।
ঐতিহাসিক
নোট
বেলারুশে কোন পারমাণবিক
বিদ্যুত কেন্দ্র নেই। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলের যে পারমাণবিক বিদ্যুত
কেন্দ্রগুলো এখনো কাজ করছে, তাদের ভেতর যেটি
বেলারুশের সবচেয়ে কাছে সেটি হলো পুরণো সোভিয়েতি নক্সার, আরবিএমকে
প্রকৃতির একটি বিদ্যুত কেন্দ্র। উত্তরে ইগনালিনস্ক স্টেশন, পূর্বে
স্মোলেনস্ক স্টেশন আর দক্ষিণে চেরনোবিল।
১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল রাত
১:২৩:৫৮ মিনিটে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুত স্টেশনের ৪ নং এনার্জি ব্লকে
রিএ্যাক্টর বা পারমাণবিক চুল্লীতে সিরিজ বিষ্ফোরণ ঘটতে থাকে। চেরনোবিলের এই
দূর্যোগ বিশ শতকের সেরা দূর্যোগ।
ছোট আয়তনের বেলারুশ
প্রজাতন্ত্রের জন্য (জনসংখ্যা: ১ কোটি), এটি ছিল একটি জাতীয় দূর্যোগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিরা ৬১৯টি
বেলারুশীয় গ্রাম এবং তাদের অধিবাসীদের সহ ধ্বংস করে। চেরনোবিল দূর্যোগে এই
প্রদেশের ৪৮৫টি গ্রাম এবং জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়। এদের ভেতর ৭০টি গ্রাম চিরতরে মাটির
নিচে গুঁড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলারুশে প্রতি চার জনে একজন নিহত হয়;
আজ বেলারুশের প্রতি পাঁচ জনের একজন একটি পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়
এলাকায় বাস করে। আজ বেলারুশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ লক্ষ মানুষ তেজষ্ক্রিয়তায়
আক্রান্ত যাদের ভেতর ৭ লক্ষই শিশু। বেলারুশের জনসংখ্যা হ্রাসে পারমাণবিক
তেজষ্ক্রিয়তা মূল বা প্রধান কারণ। গোমেল এবং মোগিলেভ এলাকায় যেখানে চেরনোবিল ঘটনায়
ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে, সেখানে আজ মৃত্যু হার জন্ম
হারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
দূর্ঘটনার ফলাফল হিসেবে ৫০
মিলিয়ন সিআই রেডিও নিউক্লিড (এটি এক ধরণের অণু যার অত্যধিক পারমাণবিক ক্ষমতা আছে
এবং যেজন্য এই অণু কখনোই স্থিতিশীল নয়) চারপাশের প্রতিবেশে নির্গত হয়। এর সত্তর
ভাগই বেলারুশে নির্গত হয়েছে; গোটা
প্রদেশের ২৩ শতাংশ এলাকায় সিসিয়াম দূষণ আর প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটারে ১৩৭
রেডিওনিউক্লিডের ঘনত্ব। অন্যদিকে ইউক্রেনের ৪.৮ শতাংশ এবং রাশিয়ার মাত্র ০.৫ শতাংশ
এলাকা রেডিওনিউক্লিডে দূষিত। মোট আবাদযোগ্য জমির ভেতরে প্রায় ১৮ মিলিয়ন হেক্টর জমি
রয়েছে যেখানে প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটারে ১ সিআই রেডিও নিউক্লিডের দূষণ রয়েছে। মোট
কৃষি অর্থনীতির ২.৪ হাজার হেক্টর জমি বরবাদ হয়ে গেছে। বেলারুশ হলো অরণ্যের দেশ।
কিন্তÍ
প্রিপিয়াত, দনিপার আর সোঝ নদীর পাশে প্রায় ২৬
শতাংশ বনভূমি এবং বিপুল পরিমাণ জলাভূমিকে বর্তমানে রেডিওএ্যাক্টিভ অঞ্চল হিসেবে
ধরা হচ্ছে। স্বল্প মাত্রার হলেও চিরস্থায়ী পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার উপস্থিতির
কারণে ক্যান্সার, মানসিক প্রতিবন্ধকতা এবং জেনেটিক মিউটেশন
ঘটে থাকে।
: ‘চেরনোবিল,’
বেলারুশস্কায়া অন্তিসিক্লোপেডিয়া।
১৯৮৬ সালের ২৯শে এপ্রিল
পোল্যান্ড, জার্মানী, অস্ট্রিয়া এবং
রোমানিয়ায় চড়া মাত্রার তেজষ্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। ৩০শে এপ্রিল নাগাদ সুইজারল্যান্ড
এবং ইতালীর উত্তরাংশে তেজষ্ক্রিয়তা ছড়ালো। মে মাসের ১ ও ২ তারিখ নাগাদ ফ্রান্স,
বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, গ্রেট বৃটেন এবং গ্রিসের উত্তরাংশে। ৩রা মে চেরনোবিলের তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে
গেল ইসরাইল, কুয়েত এবং তুরষ্কে...বাতাসবাহিত গ্যাসীয় নানা
পরমাণু উপাদান ছড়িয়ে গেল গোটা পৃথিবী জুড়ে: ২রা মে জাপান, ৫ই
মে ভারত এবং ৬ই মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বাতাসবাহিত গ্যাসীয় পরমাণু
উপাদানে আক্রান্ত হলো। মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ে গোটা বিশ্বের জন্য চেরনোবিল
একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিলো।
: ‘বেলারুশে
চেরনোবিলের প্রতিক্রিয়া।’
মিনস্ক,
শাখারভ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অন রেডিও ইকোলজি।
চতুর্থ রিএ্যাক্টরটি যাকে
আবরণী বলা হয়, এর সীসা এবং ধাতুর
তৈরি মূল অংশে রয়েছে বিশ টন পারমাণবিক জ্বালানী। কেউই ঠিক ভাবে জানে না যে এখন এই
জ্বালানী নিয়ে কি করা হচ্ছে?
পারমাণবিক এই ‘শবাধার’টি খুব ভাল ভাবেই নির্মাণ করা হয়েছিল।
অসাধারণ গঠনশৈলী এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গের যে প্রকৌশলীরা এটা তৈরি করেছিলেন তারা
সত্যিই এটির জন্য গর্ব বোধ করতে পারেন। কিন্ত মুস্কিল হলো সেন্ট পিটার্সবুর্গের
প্রকৌশলীরা নক্সা পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছিল। তারা এই বেলারুশের চেরনোবিল পর্যন্ত
এসে এটা বানায় নি। হেলিকপ্টার আর রোবটের সাহায্যে এই পারমাণবিক চুল্লী বানানো হয়,
ধাতব পাতগুলো একত্রিত করা হয়। ফলে এর নানা জায়গায় ফাটল রয়েছে। কিছু
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে চেরনোবিলে প্রায় ২০০ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে ফাটল এবং
ফাঁকা জায়গা রয়েছে এবং রেডিও এ্যাক্টিভ বা পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তা সম্পন্ন
উপাদানগুলো সেই ফাঁকা পরিসর বা ফাটলগুলো থেকে ছড়িয়ে যায়...
এই পারমাণবিক শবাধার কি
ভেঙ্গে পড়তে পারে? এ প্রশ্নের সঠিক
উত্তরটা দেয়া যে কারো পক্ষেই কঠিন। যেহেতু সাধারণ মানুষের পক্ষে চেরনোবিল
পারমাণবিক স্টেশনের অবশিষ্ট যা কিছু আছে তারও বিভিন্ন সংযোগস্থল এবং নির্মাণ কৌশল
খুঁজে দেখা ও বিচার করা আজো তাদের নাগালের বাইরে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আজো এটা
অনায়ত্ত্ব বিচার করা যে চেরনোবিলের গঠন কাঠামো কতটুকু মজবুত ছিল? তবে এটা সবাই জানে যে পারমাণবিক এ স্টেশনের মূল আবরণী যদি ভেঙ্গে পড়তো,
তবে ১৯৮৬ সালে যা ঘটেছিল তার থেকেও অনেক বাজে অবস্থা হতো।
-ওগোনিয়োগ
পত্রিকা, সংখ্যা নং-১৯, এপ্রিল ১৯৯৬
বৈশ্বিক
পরিস্থিতির পর্যালোচনা, বেলারুশ: সংসদ।
সমালোচনাকে
আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা
বেলারুশের সংসদ জাতীয়
স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করা, নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোয় যোগ দান অথবা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলাকে
নিষিদ্ধ করে। রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দার জি. লুকাশেঙ্কো যিনি আগামী বছর তৃতীয় বারের
মত নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন গত সপ্তাহে সংসদে আইনটি জমা দিয়েছেন। মূলত: জর্জিয়া,
উক্রাইন এবং কিরঘিজিস্থানে জনবিক্ষোভের প্রেক্ষিতে এই আইনটি দ্রুত
পাশ করার জন্য রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানান। এই আইনটি সরকারের উৎখাত চেয়ে যে কোন
কারাবন্দীত্বের মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারে এবং ‘দেশের
ভাবমূর্তি বিনষ্টির জন্য’ দু’বছর
পর্যন্ত কারাদন্ড ধার্য করতে পারে। আনাতোলি ভি. লেবেদকো নামে এক বিরোধী দলীয় নেতা
এই আইনকে সোভিয়েত যুগের নানা নির্যাতনমূলক আইনের সাথে তুলনা করেন। ‘সরকারের এসব কাজই দেখায় যে লুকাশেঙ্কো জানেন যে তিনি সততার সাথে দাঁড়ালে
নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন না,’ একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং ‘অর্গ্যানাইজেশন ফর সিক্যুরিটি এন্ড
কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’ এই আইনকে রাজনৈতিক বিরোধী মত ও সুশীল
সমাজের জন্য একটি হুমকি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে।
: দ্য
নিউইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ৩- ২০০৫।
প্রারম্ভিকা
একটি নি:সঙ্গ মানবিক কণ্ঠস্বর
আমরা বাতাস নই, আমরা নই
মৃত্তিকা...মেসাব মামারদাশভিলি
আমি জানি না আমার কি বিষয়ে
কথা বলা উচিত-মৃত্যু না প্রেম? অথবা তারা
কি একই? আমার তাহলে কোন্ বিষয়ে কথা বলা উচিত?
আমরা ছিলাম সদ্য বিবাহিত।
সবটা সময় আমরা হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম। এমনকি স্টোর দোকানে যাবার সময়ও। আমি তাকে
বলতাম, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’ কিন্ত
তখনো আমি জানতাম না তাকে ঠিক কতটা ভালবাসি। আমার কোন ধারণাই ছিল না...আমরা দমকল
অফিসের ডরমিটরিতে থাকতাম। ও ত’ দমকলেই কাজ করতো। দ্বিতীয়
তলায় ছিল ওর কাজের জায়গা। আমাদের সাথে ছিল আরো তিন জোড়া নবীন দম্পতি। আমরা
প্রত্যেকেই একটি রান্নাঘর ভাগ করতাম। এক তলায় ছিল অনেকগুলো ট্রাক। লাল রঙা যত দমকল
বাহিনীর ট্রাক। আমার স্বামীর কাজই ত’ ছিল এই দমকল বাহিনীর
লাল ট্রাকগুলো নিয়ে। সুতরাং আমি সবসময়ই জানতাম কি হতে যাচ্ছে- সে কোথায়, কেমন আছে।
এক রাতে আমি একটি শব্দ
শুনলাম। জানালা থেকে তাকালাম। আমার জীবনসঙ্গী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘জানালা আটকে দাও আর ঘুমাতে যাও। রিএ্যাক্টরে (পারমাণবিক চুল্লীতে)
আগুন লেগেছে। আমি দ্রুতই ফিরে আসছি।’
আমি নিজে বিষ্ফোরণ দেখিনি।
শুধু আগুনের শিখা দেখেছি। চারপাশের সবকিছুই ছিল উজ্জ্বল। গোটা আকাশটা। একটি লম্বা
আগুনের শিখা। আর ধোঁয়া। উত্তাপ ছিল ভয়ানক। এবং সে তখনো ফিরে আসেনি।
পুড়ে যাওয়া বিটুমেন থেকে
ধোঁয়ার গন্ধ আসছিল। ধোঁয়া ঢেকে ফেলেছিল বাড়ির ছাদ অবধি। পরে ও বলেছিল যে এটা ছিল
যেন আলকাতরার উপর হাঁটার মত। ওরা খুব চেষ্টা করেছিল আগুনের শিখা কমিয়ে ফেলার। ভবন
দেয়ালের পুড়ে যেতে থাকা পাথর ওরা পা দিয়ে লাথি দেয়...ওরা ওদের কাপড়ের আবরণী সেদিন
পরেনি। প্রতিদিন কাজের সময় যে সুরক্ষা আবরণী ওরা পরে,
সেটা না পরেই সেদিন ওরা ছুটে গেছিল তাদের সাধারণ শার্ট পরেই।
কর্তৃপক্ষের কেউ ওদের বলে নি যে কতটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। ঠিক যেন সাধারণ আর দশটা
আগুন লাগার মতই কোন ঘটনা ঘটেছে, এমন ছিল তাদের কথা বলার কায়দা।
ভোররাত চারটা বাজলো।
পাঁচটা। ছয়টা। সেদিন সকাল ছয়টার আমাদের ওর বাবা-মা’র কাছে তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা ছিল। আলু বুনতে। আমরা
যেখানটায় থাকতাম অর্থাৎ প্রিপিয়াত থেকে আমার শ্বশুরবাড়ি স্পেরিঝিয়ে চল্লিশ
কিলোমিটারের রাস্তা। আমার স্বামী বরাবরই ফসলের বীজ বোনা, লাঙ্গল
চষার কাজ করতে ভালবাসত। ওর মা সবসময়ই আমাকে বলতেন যে ছেলে শহরে যাক এটা তাদের
পছন্দ ছিল না। তারা ত’ ছেলের জন্য তাদের গ্রামে এমনকি একটি
নতুন বাড়িও বানিয়ে রেখেছেন। কিন্ত ও সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। মস্কোতে ফায়ার
ব্রিগেডে কাজ করলো কিছুদিন এবং সেখান থেকে চলে আসার পরও দমকলেই কাজ করতে চাইলো। সে
অগ্নি নির্বাপক হতে চেয়েছিল। অন্য কিছু নয়! (নীরবতা)
কখনো কখনো জানেন এমন মনে হয়
যেন আমি ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। জ্যান্ত। আসলে কারো কণ্ঠস্বর আমার উপর যতটা
প্রভাব বিস্তার করে ততটা তার ছবি বা আলোকচিত্র করে না। কিন্ত সে কখনোই আমাকে ডাকে
না...এমনকি স্বপ্নেও। স্বপ্নে বরাবরই আমি তাকে ডাকি।
সেই ভয়াল দিনটার কথায় ফিরে
আসি। সকাল সাতটা যখন বাজলো, তখন জানতে পেলাম যে ও
হাসপাতালে। আমি দৌড়ে গেলাম কিন্ত পুলিশ ইতোমধ্যে জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে। এবং তারা
কাউকে এর ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। শুধু এ্যাম্বুলেন্স ছিল চারপাশে। পুলিশ অফিসাররা
চেঁচাচ্ছিল: এ্যাম্বুলেন্সগুলো পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তা সম্পন্ন বা সোজা কথায়
রেডিওএ্যাক্টিভ, দূরে যাও! আমি একাই সেখানে ছিলাম না। সেই
রাতে যে যে পুরুষ রেডিওএ্যাক্টরের পাশে কর্মরত ছিল, তাদের
সবার স্ত্রীরাই এসেছে। আমি হাসপাতালের ডাক্তার আমার এক বান্ধবীকে খুঁজছিলাম। একটি
এ্যাম্বুলেন্স থেকে ও বের হওয়া মাত্র আমি ওর সাদা কোট চেপে ধরলাম, ‘আমাকে এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর ঢুকতে দাও।’ ‘না,
এখন ঢোকা যাবে না। তোমার স্বামীর অবস্থা ভাল না। কারোর অবস্থাই ভাল
না।’ আমি আমার বান্ধবীকে ছাড়লাম না, ‘একবার
ওকে দেখতে দাও!’
‘ঠিক আছে,’ ও বললো, ‘আমার সাথে আসো। পনেরো কি কুড়ি মিনিটের
জন্য।’
আমি ওকে দেখতে পেলাম। গোটা
শরীর আর মুখ ফুলে ঢোল। চোখ দু’টো যেন
দেখাই যাচ্ছিল না।
‘ওর দুধ খাওয়া প্রয়োজন।
প্রচুর দুধ।’ আমার বান্ধবী বললো, ‘প্রতি
দিন অন্তত: তিন লিটার দুধ।’
‘কিন্ত ও ত’ দুধ খেতে পছন্দ করেনা।’
‘এখন খাবে।’
পরবর্তীতে সেসময় হাসপাতালে
কাজ করা প্রচুর ডাক্তার, নার্স এবং বিশেষত:
আর্দালিরা অসুস্থ হয়ে মারা যায় যা আমরা জানতে পারি নি।
সকাল দশটায় আলোকচিত্রী
শিশেনক মারা গেল। দূর্ঘটনার রাতের পর প্রথম দিনে প্রথম সে-ই মারা গেল। আমরা জানতে
পেলাম যে ধ্বংসস্তপের নিচে ভালেরা খোদেমচুক নামে আর একজন রয়েছেন। উদ্ধারকর্মীরা
তার কাছে আর কখনোই পৌঁছতে পারেনি। কংক্রিটের স্তÍপের নিচে তাকে
কবর দেয়া হয়েছে। আমরা তখনো জানতাম না এরাই সব নয়।
হাসপাতালে ওকে দেখে আমি
বললাম, ‘ভাসিয়া, আমার কি করা
উচিত?’
‘এখান থেকে বের হও। চলে
যাও! তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান।’ কিন্ত আমি ওকে কিভাবে ছেড়ে
যাই? ও অবশ্য টানা বলেই চললো: ‘যাও!
চলে যাও! বাচ্চাটাকে বাঁচাও!’
‘আগে তোমার জন্য খানিকটা
দুধ ত’ যোগাড় করি, তারপর আমরা ঠিক করবো
কি করতে হবে?’ আমার বান্ধবী তানিয়া কিবেনক দৌড়ে এলো- ওর
স্বামীও একই কক্ষে। ওর বাবা ওর সাথে ছিল, তাঁর একটি গাড়ি
আছে। আমরা সেই গাড়িতে উঠে সবচেয়ে কাছের গ্রামটিতে দুধের খোঁজে চললাম। শহর থেকে
তিন কিলোমিটারের রাস্তা। আমরা তিন লিটার বোতল কিনলাম ছয়টা। যাতে সবার জন্য ভাল
পরিমাণ দুধ সংগ্রহ করা যায়। কিন্ত অনেক মানুষ বের হচ্ছে পারমাণবিক ধ্বংসস্তূপ থেকে।
দুধ তারা কি খাবে? তাদের হাতে ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন দেয়া
হচ্ছে। ডাক্তার তাদের বলছে যে তারা পারমাণবিক গ্যাসের বিষে বিষাক্ত। কেউই অবশ্য
পারমাণবিক বিকীরণ বা তেজষ্ক্রিয়তা বিষয়ে তাদের কিছু বলেনি। গোটা শহরটি সামরিক
গাড়িতে আকীর্ণ। সামরিক গাড়িগুলো শহরের সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রলিগুলো ছোটা
বন্ধ করেছে। ট্রেনগুলোও। রাস্তাগুলো কিছু একটা সাদা পাউডার গুঁড়ায় ধোয়া হচ্ছে। আমি
চিন্তা করছিলাম পরদিন আরো খানিকটা তাজা দুধ সংগ্রহের জন্য গ্রামে যাব কিভাবে?
কেউই তেজষ্ক্রিয়তার বিষয়ে কোন কথা বলছে না । তেজষ্ক্রিয়তা এড়াতে
শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই মুখোশ পরা ছিল। শহরের মানুষেরা স্টোর দোকানগুলো
থেকে রুটি নিয়ে যাচ্ছিল। খোলা ব্যাগে রুটির টুকরোগুলো ভরা। দিব্যি মানুষজন প্লেটে
কেক রেখে খাচ্ছে।
সেই সন্ধ্যায় আমার হাসপাতাল
যাওয়া হয়নি। রাস্তায় যেন জনসমুদ্র। হাসপাতালের যেখানটায় আমার স্বামী ছিল,
সেই ফ্লোরের জানালার নিচে আমি দাঁড়ালাম। ও এলো এবং আমার দিকে চিৎকার
করে কিছু যেন বললো। সবটাই কেমন যে হতাশা ভরা! ডভড়ের ভেতর একজন অবশ্য তাকে শুনতে
পেয়েছে- ঐ রাতেই ওদের মস্কো নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের স্ত্রীরা যেন সবাই একজায়গায় জড়ো
হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা ওদের সাথে যাব। আমাদেরকে মস্কোতে যেতে দাও।
আমাদের জীবনসঙ্গীদের সাথে! না, তোমাদের অনুমতি নেই!
কর্তৃপক্ষ জানালো। আমরা ধ্বস্তাধস্তি, আঁচড়া-আঁচড়ি শুরু
করলাম। কিন্ত সৈন্যরা- ইতোমধ্যে সেনা মোতায়েন হয়েছে- তারা আমাদের ঠেলে পেছনে
পাঠিয়ে দিল। তখন ডাক্তার এলেন এবং বললেন, হ্যাঁ- ওদের আজই
মস্কোর উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে হবে, তবে আমাদের বাসা থেকে ওদের
পরিধেয় কাপড়-চোপর আনতে হবে। দূর্ঘটনার রাতে যে কাপড় পরে তারা স্টেশনে কাজ করতে
গেছিল সেসব ত’ পুড়ে গেছে। এর ভেতরে শহরে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে
গেছে। তাই আমরা গোটা শহর দৌড়ে দৌড়ে বাসায় গেলাম। আমরা যখন ব্যাগে ওদের জামা-কাপড়
ভরে আবার হাসপাতালে এলাম, ততক্ষণে ওদের সবাইকে নিয়ে বিমান
মস্কোর দিকে উড়াল দিয়েছে। আমাদের সাথে কি বিশ্রী কৌশল করা হলো! যেন আমরা ওদের
সামনে কান্না-কাটি, চেঁচামেচি করতে না পারি!
রাত হয়েছে। রাস্তার একদিকে
শত শত বাস যারা শহর থেকে অধিবাসীদের নিয়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তত আর অন্যদিকে শত
শত দমকল বা অগ্নি নির্বাপনের গাড়ি। এই বাস আর অগ্নি নির্বাপক গাড়িগুলো নানা জায়গা
থেকে এসেছে। গোটা রাস্তা সাদা পরিচ্ছন্নতাকারী পাউডার জলে গুলানো ফেনায় ঢাকা। আমরা
এর উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, কাঁদছিলাম আর অভিশাপ
দিচ্ছিলাম। বেতারে কর্তৃপক্ষ বলছিল যে আগামী তিন থেকে পাঁচ দিনের ভেতর আমাদের
সবাইকে হয়তো শহর ছাড়তে হবে, আমরা যেন আমাদের সাথে গরম কাপড়
গুছিয়ে রাখি, কারণ আমাদের এমনকি বনেও থাকতে হতে পারে।
তাঁবুতে। কিছু মানুষ আবার বোকার মত খুশিও হচ্ছিল- কি সুন্দর বনভোজনে তাঁবু পাতার
ব্যবস্থা! যেন আমরা মে দিবস পালন করতে যাচ্ছি, প্রতিদিনের
রুটিন থেকে একটি ছুটি মেলা। অনেকে আবার বারবিকিউয়ের ব্যবস্থাও করতে লাগলো। কেউ কেউ
সাথে গিটার আর রেডিও নিচ্ছে। শুধু যে নারীদের স্বামীরা পারমাণবিক স্টেশনে কাজ
করেছে তারা কাঁদছিল।
বাবা-মা’র বাড়িতে যাবার ভ্রমণের কথা আমি এখন মনে করতে পারি না। যেন আমি ঘুম থেকে
জেগে উঠে মা’কে দেখলাম আর বললাম, ‘মা,
ভাসিয়া মস্কোতে। ওরা ওকে একটি বিশেষ বিমানে করে নিয়ে গেছে!’ কিন্ত এই বেদনার ভেতরেই আমি মা’র সাথে সব্জির বীজ
পোঁতার কাজ করছি বাগানে। (এক সপ্তাহ পর
গ্রামটিও খালি করে দিতে হলো)। কে জানত? কে জানত এর পর কি হবে?
পরের দিন আমি জিনষিপত্র সব ছুঁড়তে শুরু করেছি। আমি তখন ছ’মাসের অন্তসত্ত্বা। আমার সব কিছু খুব খারাপ লাগছিল। সে রাতে আমি স্বপ্নে
দেখলাম সে আমাকে তার ঘুমের ভেতরে ডাকছে: ‘লিয়্যুশা!
লিয়্যুসেঙ্কা!’ তবে ওর মৃত্যুর পর আর ও আমাকে স্বপ্নে ডাকে
নি। একবারও না (বিধবা মেয়েটি এটুকু বলে কাঁদতে শুরু করলো)। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে
ভাবা শুরু করলাম যে আমাকে মস্কো যেতে হবে। আমি একাই যাব। মা তখন কাঁদছে, ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি, শরীরের এ অবস্থায়?’ তখন বাবাকে সাথে নিলাম। বাবা আমাকে প্রথমে ব্যাঙ্কে নিয়ে গেলেন আর সেখান
থেকে আমি আমার সঞ্চয়ের সব টাকা তুলে ফেললাম।
আমার সেই যাত্রার কথা মনে
পড়ে না। মস্কোয় যাবার সব স্মৃতি আমি ভুলে বসে আছি।
মস্কোতে প্রথম যে পুলিশ
অফিসারকে দেখলাম, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম
যে চেরনোবিলের অগ্নি নির্বাপণকারীদের তারা কোথায় রেখেছে? তিনি
অবশ্য উত্তর দিলেন। উত্তর যে দিলেন এটাই বেশ অবাক করা। কারণ আমরা ভয় পাচ্ছিলাম যে
এটা হয়তো কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত গোপনীয়তা হিসেবে রক্ষা করবে। কিন্ত পুলিশ অফিসার
আমাদের জানালেন, ‘হাসপাতাল নম্বর ৬। শুচুকিনস্কায়া বাস
স্টপে।’
এটা ছিল একটি বিশেষায়িত
হাসপাতাল। রেডিওলজির জন্য বিখ্যাত। কোন পাস ছাড়া ঢোকা যেত না। দ্বাররক্ষীনী
নারীটিকে আমি কিছু টাকা দিলাম। তখন সে বললো, ‘যাও।’ এরপর হাসপাতালের ভেতরে রেডিওলজি বিভাগে যেতে
আরো কাউকে কাউকে অনুনয় বিনয় করলাম। শেষপর্যন্ত হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান
ভাসিলিয়েভনা গুস্কোভার অফিসে তাঁর সামনে বসা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম। তখনো
অব্দি আমি অবশ্য তাঁর নাম জানি না...সত্যি বলতে এত দিন পর কোন কিছুই আর হুবহু মনে
নেই। আমি শুধু জানতাম যে ভাসিয়াকে এক নজর আমার দেখতে হবে। তখনি তিনি জিজ্ঞাসা
করলেন:
‘তোমার কি বাচ্চা আছে?’
কি বলবো ওনাকে একথার উত্তরে?
বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমি যে গর্ভবতী এটা তাঁর কাছ থেকে লুকনো
দরকার। নাহলে আমাকে ওর সাথে এরা দেখা করতে দেবে না। তা-ও ভাগ্য ভাল যে আমি এখনো
পাতলা আছি। আমাকে দেখে হুট করে বোঝা যায় না।
‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম।
‘কয়টা বাচ্চা?’
আমি তখন ভাবছি,
‘ওনাকে বলি যে আমার দু’টো বাচ্চা আছে। মাত্র
একটি বাচ্চা আছে জানলে যদি আমাকে ঢুকতে না দেয়?’
‘এক ছেলে এক মেয়ে,’
আমি বললাম।
‘তাহলে আর ত’ কোন বাচ্চা তোমার দরকার নেই। ঠিক আছে, শোন: তোমার
স্বামীর সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে, মাথার খুলিও প্রায় সবটা গেছে।’
আচ্ছা,
আমি ভাবতে থাকলাম তবে বোধ করি ও এখন খানিকটা বেশ কষ্টেই আছে।
‘আর শোন: ওকে দেখে তুমি
যদি কান্না শুরু করো, তাহলে তোমাকে একদম লাথি মেরে বের করে
দেয়া হবে। কোন জড়িয়ে ধরা না, চুমু না। এমনকি ওর কাছেও ঘেঁষবে
না। তোমার মাত্র আধা ঘন্টা সময় আছে।’
কিন্ত আমি তখনি জানতাম যে
আমি এ হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যাব না। আর যদি ছাড়তে হয়, তবে ওকে সাথে নিয়েই ছাড়ব, এটা নিজের কাছেই নিজে শপথ
করেছিলাম! আমি ঘরের ভেতর ঢুকে দেখলাম আমার স্বামী আর তার বন্ধুরা বিছানায় বসে তাস
খেলছে আর হাসছে।
‘ভাসিয়া!’ ওর বন্ধুরা ওকে ডাকলো।
ও ফিরে তাকালো।
‘ওহ, সব গেল! মেয়েটা এখানেও আমাকে খুঁজে বের করলো!’
ওকে কেমন মজার দেখাচ্ছিল।
৪৮ সাইজের পাজামা পরণে যদিও ওর সাইজ ৫২। পাজামার পাগুলো ওর পায়ে ছোট হয়ে গেছে,
প্যান্টও খুব ছোট। তবে ওর মুখটা আর ফোলা দেখাচ্ছে না। সম্ভবত: ওদের
কিছু তরল খাবার খাওয়ানো হয়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তুমি আমার কাছ থেকে কোথায় পালাবে?’
ভাসিয়া বোধ করি আমাকে জড়িয়ে
ধরতে চাইছিলো, কিন্ত ডাক্তার ত’
সেটা হতে দেবেন না। তিনি বললেন, ‘বসো, বসো। এখানে কোন জড়িয়ে ধরা চলবে না।’
আমরা এটাকে যাহোক খানিকটা
যেন ঠাট্টার ভাবে নিয়েছি এমন দেখালাম। তারপ একে একে সবাই জড়ো হলো,
অন্যান্য কক্ষ থেকেও অনেকে এলো। এরা প্রত্যেকেই প্রিপিয়াত থেকে
এসেছে। বিমানে তাদের প্রায় আঠাশ জন একসাথে ছিল। কি হচ্ছে আসলে সব মিলিয়ে? শহরের অবস্থা কেমন? ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো। আমি
ওদের বললাম যে সবাইকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, গোটা শহরই আগামী তিন
থেকে পাঁচ দিনের ভেতর খালি করে ফেলা হবে। পুরুষেরা কেউই কোন কথা বলছে না। তবে একজন
নারী- দু’জন নারীও ছিল এই হাসপাতালে অন্তরীণদের ভেতর- বললো
যে দূর্ঘটনার দিন সে ছিল কারখানায় ডিউটিতে। এটুকু বলে সে কাঁদতে শুরু করলো।
‘হে ঈশ্বর! আমার
বাচ্চারা ত’ সেখানে। ওদের কি অবস্থা?’
সবার নানা প্রশ্ন বা
কান্নাকাটির ভেতর মনে হচ্ছিল যে শুধু যদি আমার স্বামীর সাথে আমি একটা মিনিট সময়ও
আলাদা করে পেতাম। অন্য পুরুষেরা বুঝলো। তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন অজুহাতে
কিছুক্ষণের ভেতর সবাই রুম খালি করে দিল। এবার আমি ভাসিয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলাম।
ও অবশ্য একটু সরে বসলো।
‘আমার কাছে বসো না।
একটি চেয়ার নিয়ে নাও বরং।’
‘এটা কেমন হাস্যকরা
কথা!’আমি হাত নেড়ে বলে উঠলাম, ‘আচ্ছা
তুমি কি বোমা বিষ্ফোরণ দেখেছো? তুমি কি দেখেছো কি হয়েছে?
তুমি ত’ সেখানে ঘটনার সময় সামনা সামনি ছিল
তাদের একজন।’
‘সম্ভবত: এটা কোন
অন্তর্ঘাত হয়ে থাকবে। আমাদের ভেতর সবাই ত’ তেমনটা ভাবছে।’
তখন মানুষ এমনটাই বলছিল
অবশ্য। সবাই এভাবেই ভাবছিল।
এর পরের দিন। সবাই যে যার
কক্ষে শুয়ে ছিল। ওদের কারো করিডোরে যাবারও অনুমতি ছিল না কিম্বা একে অপরের সাথে
কথা বলার অধিকার। দেয়ালে আঙ্গুল দিয়ে তারা ঠক ঠক করতো। খট খট,
খট খট। ডাক্তার সবার কাছে ব্যখ্যা করতেন যে পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার
ক্ষেত্রে সবার শরীর একই রকম প্রতিক্রিয়া করে না। একজন যা সইতে পারে তা’ হয়তো আর একজন পারে না। তারা এমনকি দূর্ঘনার দিন পারমাণবিক স্টেশনের যেখানে
ছিল সেখানকার দেয়ালের তেজষ্ক্রিয়তা পর্যন্ত পরিমাপ করেছে। ডানে, বামে এবং নিচের মেঝেতে। তারা স্টেশনের নিচের এবং উপরের তল থেকে সব অসুস্থ
মানুষকে সরিয়েছে।
তিন দিনের মত আমি আমার
বন্ধুদের সাথে মস্কোতে থাকলাম। তারা সবাই আমাকে বললো: তোমার যা খুশি নিয়ে যাও।
থালা নাও, বাটি নাও, যা যা দরকার
হাসপাতালে নিয়ে যাও! আমি ছয়জনের জন্য টার্কি স্যুপ বানালাম। আমাদের শহরের ছয় জন
অগ্নি নির্বাপণ কর্মীর জন্য। যারা একই শিফটে কাজ করতো। প্রত্যেকেই তারা দূর্ঘটনার
রাতে ডিউটিতে ছিল: বাশুক, কিবেনক, টিটেনক,
প্রাভিক, তিশ্চুরা। আমি স্টোর দোকানে গিয়ে
ওদের সবার জন্য টুথপেস্ট, টুথব্রাশ এবং সাবান কিনলাম। হাসপাতালে
এসব কিছুই তাদের জন্য ছিল না। আমি ওদের সবাইকে ছোট ছোট তোয়ালেও কিনে দিলাম। আজ
পিছন ফিরে তাকালে মস্কোয় বসবাসরত আমার বন্ধু-বান্ধবীদের কথা ভেবে আমি বিষ্মিত হই।
নিশ্চিত। চারপাশে চেরনোবিলের তেজষ্ক্রিয়তা আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কত না গুজব
ছড়াচ্ছিল! ওদের কাণেও নিশ্চয় গেছিল। তবু কেমন আমাকে ভরসা দিয়ে বলেছে: যা যা লাগে
সব নিয়ে যা হাসপাতালে! তোর বর কেমন আছে? ওর বন্ধুরা সবাই ভাল
আছে? ওরা কি বাঁচবে? বাঁচা (মেয়েটি
আবার চুপ করে যায়)। সেই কষ্টের সময়টা না আমার সাথে অনেক ভাল মানুষের পরিচয় হয়েছে।
তাদের সবার কথা আমার মনে নেই। হাসপাতালের এক বৃদ্ধা পরিচ্ছন্নতাকর্মী আমাকে
শেখালেন, ‘কিছু অসুস্থতা আছে যা আর ভাল করা যায় না। তোমাকে
বসে থেকে দেখতে হবে, সইতে হবে।’
সকাল বেলা আমি বাজারে যেতাম,
তারপর যেতাম বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়িতে যেখানে গিয়ে আমি স্যুপ রান্না
করতাম। সব সব্জি-আনাজ, মাংস টুকরো টুকরো করে কেটে পিষতাম।
কেউ হয়তো বলতো, ‘আমার জন্য একটু আপেল জ্যুস এনো।’ তা’ আমি তখন ছয়টা আধা লিটার আপেল জ্যুসের ক্যান নিয়ে
যেতাম! হাসপাতালে দৌড়ে দৌড়ে যাই। সেখানে সন্ধ্যা অবধি বসে থাকি। সন্ধ্যা বেলায়
আবার গোটা শহর মাড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের বাসায় ফিরি। কিন্ত এভাবে কতদিন পারা যাবে?
তিন দিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে বললো হাসপাতাল কর্মীদের ডরমে
আমি থাকতে পারি। হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই এই ডরমিটরি। হে ঈশ্বর, কি দারুণ হয়ে উঠলো সবকিছু!
‘কিন্তÍ
এখানে ত’ কোন রান্নাঘর নেই। আমি কিভাবে রান্না
করবো?’
দেখতে দেখতে আমার স্বামী বদলাতে
শুরু করলো- প্রতিদিনই আমি সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যক্তিকে দেখি। পারমাণবিক
তেজষ্ক্রিয়তায় ওর ভেতরের পুড়ে যাওয়াটা এবার চেহারায় বাহ্যিক রূপ নেয়া শুরু করলো।
প্রথমে ওর মুখে, তারপর জিহ্বা,
তারপর গালে- শুরুতে কিছু ছোট ছোট ঘায়ের মত দেখা দিল, তারপর এই ঘা বাড়তে লাগললো। পরতে পরতে বাড়তে থাকলো- যেন বা একটি সাদা
ফিল্মের উপর স্তরে স্তরে রং চাপছে- তার মুখের রং-
শরীর...নীল...লাল...ছাই...বাদামী। অথচ এই মুখটি- এই মুখাবয়বের মানুষটি আমার কতটা
না নিজের! এ যে বর্ণনা করা অসম্ভব! লেখাও অসম্ভব! এই স্মৃতির হাত থেকে উদ্ধার
পাওয়াও কঠিন। একমাত্র বিষয় যা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তা’ হলো
সব কিছু খুব দ্রুত গতিতে ঘটছিল। কিছু ভাবার বা চিন্তা করার সময় ছিল না, কান্নাকাটি করারও কোন সময় ছিল না।
আমি ওকে ভালবাসতাম! আমার
নিজেরই কোন ধারণা ছিল না যে কি পরিমাণ ভাল তাকে বাসতাম! আমরা তখন মাত্র বিয়ে
করেছি। রাস্তায় হাঁটার সময় ও সবসময় আমার হাত ওর হাতের মুঠিতে ভরে নিত আর আমাকে এক
পাক ঘোরাতো। আর তারপর ভরিয়ে তুলতো আমাকে চুমুর পর চুমুতে। আশপাশের চোদ্দ দিন।
মানুষজন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দেখে হাসতো।
এই হাসপাতালটা ছিল তীব্র
পারমাণবিক বিষক্রিয়ায় অসুস্থ মানুষদের সেরে ওঠার জন্য। চোদ্দতম দিনে একজন মারা
গেল।
হাসপাতালের প্রথম দিনেই
আমাকে ডরমিটরিতে একটি ডসিমিটার দিয়ে মাপা হলো। আমার কাপড়চোপর,
ব্যাগ, পার্স, জুতা-
সবকিছুই ছিল ‘গরম।’ এবং তারা এসবকিছুই
আমার কাছ থেকে নিয়ে নিল। এমনকি আমার অন্তর্বাসগুলোও। শুধু আমার টাকা-পয়সা আমাকে ফেরত
দেয়া হলো। বদলে তারা আমাকে হাসপাতালের একটি পোশক দিল পরতে- এটা ৫৬ সাইজের একটি
জামা- আর ৪৩ সাইজের চপ্পল। তারা বললো যে আমাকে যথাসময়ে আমার সব কাপড়চোপর ফেরত
দেবে। হয়তো দেবে বা হয়তো দেবে না। কারণ তখন এমন অবস্থা যে কাপড়চোপর ধোওয়াটা ত’
কঠিন। তা’ হাসপাতাল ডর্মে উঠে তেমন পোশাকে আর
চেহারাতেই আমি আমার স্বামীকে দেখতে গেলাম। ও ত’ আমাকে দেখে
ভয় পেয়ে গেছিলো, ‘মেয়ে, তোমার এ কি হাল
চেহারার?’ তবু সেই অবস্থায় আমি ত’ ওকে
অন্তত: খানিকটা স্যুপ বানিয়ে দিতে পেরেছি। একটি কাঁচের জারে খানিকটা জল গরম করতাম,
তারপর সেই জলে ফেলে দিতাম মুরগীর কিছু টুকরো- ছোট, ছোট টুকরো। তারপ একজন আমাকে একটি বাটি দিল, যত দূর
মনে পড়ে পাহারাদার অথবা পরিচ্ছন্নতা কর্মী কোন নারী। একজন দিল মাংস, সব্জি এসব কাটার জন্য একটি বোর্ড- যেন আমি পার্সলি পাতা ভাল ভাবে কুচি
করতে পারি। হাসপাতালের পোশাকে আমি বাজারে যেতে পারতাম না; তখন
হাসপাতালের অন্য কর্মীরা আমাকে সব্জি এনে দিত। কিন্ত এসবকিছুই দিন দিন অর্থহীন হয়ে
পড়ছিল। ও ত’ দিন দিন এত দূর্বল হয়ে যাচ্ছিল যে খাওয়া দূরের
কথা, কিছু পানও করতে পারছিল না। একটি কাঁচা ডিমও সে গিলতে
পারত না। কিন্ত আমি চাইতাম ওকে সুস্বাদু কিছু বানিয়ে খাওয়াতে! যেন বা ওর স্বাদে
বিস্বাদে তখন সত্যি কিছু যেত আসত! আমি ডাকঘরে দৌড়ে গেলাম একদিন, ‘মেয়েরা,’ আমি তাদের বলতাম, ‘ইভানো-ফ্রাঙ্কোভস্কে
আমার বাবা-মা’কে ফোন করাটা আমার জন্য এখন খুব জরুরি। আমার
স্বামী মারা যাচ্ছে।’ তারা সাথে সাথে বুঝে যেত যে আমি কোথা
থেকে এসেছি আর আমার স্বামী কে? ওরা তখন সাথে সাথে আমাকে আমার
বাবা-মা’র সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিল। আমার বাবা, বোন আর ভাই সেদিনই মস্কোতে উড়ে এলো। তারা আমাকে আমার জন্য আরো কিছু
কাপড়চোপর আর অন্যান্য জিনিষপত্র এনে দিলো। এটা ছিল মে মাসের নয় তারিখ। আমার স্বামী
প্রায়ই আমাকে বললো, ‘তোমার কোন ধারণাই নেই যে মস্কো কত
সুন্দর! বিশেষ করে বিজয় দিবসে, যখন সবাই বাজি ফোটায়! আমি চাই
তুমি সেটা দ্যাখো।’
আমি ওর সাথে ওর হাসপাতাল
কক্ষে বসে থাকতাম, সে চোখ মেলতো,
‘এটা কি দিন না রাত?’
‘এখন রাত নয়টা।’
‘জানালা খোল! ওরা এখন
বাজি ফোটাবে!’
আমি জানালা খুললাম। আমরা
ছিলাম অষ্টম তলায় এবং গোটা শহর তখন আমাদের সামনে! বাতাসে আগুনের তোড়া ফুলঝুরি হয়ে
ছড়িয়ে যাচ্ছে।
‘ওদিকে তাকাও!’ আমি ভাসিয়াকে বললাম।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম
যে আমি তোমাকে মস্কো দেখাব এবং আমি তোমাকে এটাও বলেছিলাম যে প্রত্যেক ছুটির দিনে
আমি তোমাকে ফুল দেব...’
আমি ফিরে তাকাতেই দেখলাম
ভাসিয়া ওর বালিশের নিচ থেকে তিনটি কারনেশন ফুল বের করছে। ও লুকিয়ে নার্সকে টাকা
দিয়েছিল আর নার্স কথামতো সেই ফুল আমার জন্য কিনে এনেছে।
পাগলের মত তখন ওর কাছে দৌড়ে
গিয়ে ওকে চুমু দিলাম।
‘প্রেম আমার! আমার এক
এবং একমাত্র প্রেম!’
ভাসিয়া রেগে চাপা গলায় বকতে
লাগলো, ‘ডাক্তাররা তোমাকে কি বলেছে? আমাকে জড়িয়ে ধরা যাবে না! আর কোন চুমুও দেয়া যাবে না!’
ওহ্- এই হাসপাতালের লোকেরা
আমাকে আমার ভাসিয়াকে জড়িয়েও ধরতে দেবে না। কিন্তু আমি...ওকে ধরে তুললাম এবং বসিয়ে
দিলাম। ওর বিছানা করে দিলাম। থার্মোমিটারটা যেখানে রাখার রেখে দিলাম। ওর
থুত-মল-মূত্রের পাত্র বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার করে আবার ওর বিছানার কাছে এনে রাখলাম।
তারপর ওর সাথে থাকলাম সারাটা রাত।
ভাগ্য ভাল যে ভাসিয়ার রুমে
না বরং করিডোরে একদিন মাথা ঘুরে উঠলো আমার। জানালার গরাদ চেপে ধরলাম। এক ডাক্তার
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন। তারপর বলে বসলেন: ‘আপনি কি গর্ভবতী?’
‘না, না!’ খুব ভয় লাগছিলো যে কেউ যদি শুনে ফ্যালে!
‘মিথ্যে কথা বলবেন না!’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
পরের দিন সকালে প্রধান
ডাক্তারের কক্ষে ডাক পড়লো।
‘আমাকে মিথ্যে বলেছিলে
কেন?’
‘অন্য কোন উপায় ছিল না।
আমি যদি আপনাকে সত্যি কথা বলতাম, তবে আমাকে ত’ বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এটা মিথ্যা হলেও পবিত্র মিথ্যা।’
‘তুমি কি করেছো বুঝতে
পারছো?’
‘যা-ই করি না কেন,
তবু ত’ ওর পাশে থাকতে পেরেছি!’
এ্যাঞ্জেলিনা ভাসিলিয়েভনা
গুস্কোভার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার গোটা জীবন জুড়ে কৃতজ্ঞ থাকবো তাঁর প্রতি।
অন্যদের স্ত্রীরাও এসেছিলেন তবে তারা কেউই ভেতরে যাবার অনুমতি পায় নি। এর ভেতর
আমাদের পারিবারিক বন্ধু ভলোদিয়া প্রাভিকের মা ঈশ্বরের কাছে কান্না শুরু করলেন: ‘আমার ছেলের বদলে আমাকে তুলে নাও!’
একজন মার্কিনী অধ্যাপক ড:
গেল- আমার স্বামীকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় ওর অস্থি মজ্জা (বোন ম্যারো) অপারেশন
করেন। ড: গেল আমাকে স্বান্তনা দেবার অনেক চেষ্টা করছিলেন। তিনি বললেন যে ক্ষুদ্র
একটি আশার রেখা এখনো আছে- হয়তো সে রেখা খুব জোরালো না- তবু আমার স্বামী এত
শক্ত-পোক্ত এক যুবক ছিল! শেষ চেষ্টা করে দেখা যায়। আমার বরের সব রক্ত-সম্পর্কের
আত্মীয়কে ডাকা হরো। বেলারুশ থেকে ওর দুই বোন এলো, ভাই এলো লেনিনগ্রাদ থেকে যে সেখানে সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করতো।
ওর দুই বোনের ভেতর ছোট বোনটির বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ। নাতাশা ত’ এত ছোট যে ভয় পেয়ে কান্না-কাটি শুরু করলো। কিন্ত ওর অস্থি মজ্জা
(বোন ম্যারো) সবচেয়ে বেশি ওর ভাইয়ের বোন ম্যারোর সাথে মিলে গেছিল (নীরবতা)। এখন আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারি। কিন্ত
আগে একটা সময় এ বিষয়ে কিছু বলতেই পারি নি। এসব নিয়ে গত দশ বছর আমি কোন কথা বলি নি
(নীরবতা)।
কিন্ত আমার স্বামী যখন
বুঝলো যে সবাই ছোট্ট নাতাশার বোন ম্যারো নিতে চাইছে ওকে সুস্থ করার জন্য,
ও একদম সরাসরি না করে দিল, ‘আমি বরং মরবো তবু
ওরটা নেব না। ও এত ছোট- ওকে যেন একদম ছোঁওয়া না হয়!’ ওর বড়
বোন লিয়্যুডার বয়স তখন আঠাশ। সে নিজেই ছিল একজন নার্স। ও জানতো ভাইয়ের জন্য সে কি
করতে যাচ্ছে। ‘যতক্ষণ ভাই বেঁচে আছে, ততক্ষণ
ওর জন্য শেষ চেষ্টা ত’ করতেই হবে,’ লিয়্যুডা
বললো। আমি গোটা অস্ত্রোপচারটাই দেখলাম। টেবিলের ওপর ওরা দু’জন
পাশাপাশি শোওয়া ছিল। অস্ত্রোপচার কক্ষে একটি বড় জানালা ছিল। দুই ঘন্টা লাগলো।
অস্ত্রোপচার যখন শেষ হলো, লিয়্যুডার অবস্থা তার ভাইয়ের থেকেও
যেন খারাপ দেখাচ্ছিল। ওর বুকের আঠারোটি জায়গায় ছিদ্র করা হয়েছে, এ্যানেস্থেশিয়ার ঘোর থেকে ও যেন বের হতেই পারছিল না। আজো লিয়্যুডা অসুস্থ।
আজ ও প্রায় পঙ্গু। অথচ একটা সময় ও ছিল দিব্যি শক্ত-সমর্থ, সুন্দরী
একটি মেয়ে। আর বিয়ে করা হয় নি ওর। অস্ত্রোপচার শেষ হবার পর আমি দুই ভাই-বোনকে যে
দুই রুমে রাখা হয়েছিল, সেই দুই রুমে ছোটাছুটি করছি। এর রুম
থেকে ওর রুমে। আমার বরকে কোন সাধারণ হাসপাতাল কক্ষে রাখা হয় নি। একটি বিশেষায়িত
বায়ো-চেম্বারে একটি স্বচ্ছ পর্দার অন্তরালে ওকে রাখা হলো। ভেতরে কারো যাবার অনুমতি
নেই।
পর্দার এপারে নানা
যন্ত্রপাতি এমনভাবে সাজানো যে পর্দার ওপাশে না গিয়েই ভাসিয়াকে ইঞ্জেকশন দেওয়া যায়,
ক্যাথেটার ঠিকঠাক করা যায়। পর্দাগুলো ভেলক্রো ক্লিপে আঁটা। আমি এই
পর্দা ব্যবহার করতে শিখে গেছি। পর্দার কুচিগুলো একপাশে সরিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম। ওর
বিছানার পাশে একটি ছোট্ট চেয়ার। ওর অবস্থা এত খারাপ হয়ে পড়েছে যে ওকে ছেড়ে এক
মূহুর্তের জন্য আমি কোথাও যেতে পারতাম না। ও আমাকে প্রায় সবটা সময় ডাকতো, ‘লিয়্যুশা, তুমি কোথায়? লিয়্যুশা!’
ও ডেকেই চলতো। অন্যান্য বায়োচেম্বারে, যেখানে
আমাদের ছেলেরা থাকতো আর সৈন্যরা তাদের দেখা-শোনা করতো (যেহেতু আর্দালিরা এই
তেজষ্ক্রিয়তার শিকার রোগীদের দেখা-শোনা করার নির্দেশ অমান্য করেছিল), সেই সব বায়োচেম্বারের রোগীরা তাদের আচ্ছাদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কাপড়
চাইছিলো। সৈন্যরা এই চূড়ান্ত অসুস্থ রোগীদের বেডপ্যান বহন করতো। মেঝে মোছা,
বিছানা বদলের কাজও তারা করে দিত। সব কিছু এই সৈন্যরা করত। কর্তৃপক্ষ
সেবা-শুশ্রুষার কাজে এত সৈন্যই বা কোথা থেকে পেয়েছিল? আমরা এ
প্রশ্ন করিনি। কিন্তÍ সে- সে- প্রতিদিনই
ভাসিয়া বলতো: মৃত। মৃত। তিশ্চুরা মারা গেছে। টিটেনক মারা গেছে। মৃত। আমার
মস্তিষ্কে এসব কথায় যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়তো।
শেষের দিকে ভাসিয়ার দিনে ২৫
থেকে ৩০ বার মল ত্যাগ হত। সাথে বের হত রক্ত এবং শ্লেষ্মা। ওর হাত এবং পায়ে চামড়া
ফেটে বের হওয়া শুরু হলো। সারাটা সময় ও ... ঢাকা থাকত। যখনি ও মাথা ঘোরাত,
ওর বালিশে এক গোছা চুল উঠে আসতো। আমি ঠাট্টা করার চেষ্টা করতাম: ‘এই ত’ বেশ ভাল দ্যাখো- তোমার এখন চিরুনী লাগে না।’
দ্রুতই ওর সব চুল কেটে ফেলা হলো। আমি নিজেই ওর চুল কেটে দিলাম। ওর
সব কাজ আমি নিজেই করে দিতে চাইতাম। যতটা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব হত। ওর সাথে
চব্বিশটা ঘন্টাই থাকতে চাইতাম। একটি মিনিটও আমি এদিক ওদিক করতে পারতাম না (দীর্ঘ
নীরবতা)। আমার ভাই এলো এবং সে সবকিছু দেখে ভয় পেয়ে গেল, ‘আমি
তোমাকে এখানে ঢুকতে দেব না!’ কিন্ত আমার বাবা আমার ভাইকে
বললেন, ‘তুমি কি মনে করো ওকে থামানো যাবে? দরকার হলে ও জানালার ভেতর দিয়ে গলিয়ে ঢুকবে। ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার
ভেতর দিয়ে যাবে!’
আমি হাসপাতালে ফিরে গেলাম
এবং বিছানার পাশে ওর টেবিলে দেখলাম কমলালেবু রাখা। বড় আর গোলাপী রঙের। সে হাসছিল: ‘আমি এটি উপহার পেয়েছি। নাও।’ এর ভেতরে নার্স আমাকে
ইঙ্গিত করছিল যে আমি এটা খেতে পারি না বা খাওয়া উচিত নয়। এই কমলালেবুটি যেহেতু ওর
কাছে ছিল তাই এটি যে তুমি শুধু খেতে পার না তা’ নয়, তুমি এটা ছুঁতেও পার না। এর ভেতরেই ভাসিয়া ওর চোখ বন্ধ করলো এবং ঘুমিয়ে
গেল। ডাক্তাররা ওকে সবসময় ইঞ্জেকশন দিত যেন ঘুমোতে পারে। নার্স আমার দিকে ভয়
মিশ্রিত চোখে তাকিযে আছে। আর আমি? ও যেন শুধু মৃত্যুর কথা
চিন্তা না করে সেজন্য যা যা কিছু করা লাগে আমি করতে প্রস্তত। ওর মৃত্যু কত ভয়াবহ
হবে সেটা ভেবে ওকে নিয়ে সারাক্ষণই উদ্বেগে থাকি। মাঝে মাঝে নানা কথোপকথনের টুকরো
টুকরো অংশ মনে পড়ে। তখন কতজন কত কথা বলেছে আমাকে! কেউ হয়তো বলেছে: ‘তোমাকে বুঝতে হবে: এই ছেলেটা যাকে তুমি তোমার স্বামী বলে এখনো ভাবছো,
সে আর তোমার বর সেই ছেলেটা নেই! ও একটা রেডিওএ্যাক্টিভ বা
তেজষ্ক্রিয়তা সম্পন্ন বস্ত যার আছে চারপাশের সবকিছুকে বিষাক্ত করার তীব্র ঘনত্ব ও
ক্ষমতা। তুমি কেন আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছো? নিজের উপর
নিয়ন্ত্রণ রাখো!’ আর আমি হলাম যেন তেমন কারো মত যে তার মনের নিয়ন্ত্রণ
হারিয়েছে: ‘কিন্ত আমি ওকে ভালবাসি! আমি ওকে ভালবাসি!’
ও ঘুমোচ্ছে আর আমি ফিসফিস করছি ওর পাশে বসে, ‘আমি
তোমাকে ভালবাসি!’ হাসপাতালের বারান্দা চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে
বলছি: ‘আমি তোমাকে ভালবাসি!’ ওর
মল-মূত্র-থুতুর পাত্র বাথরুমে পরিষ্কার করতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলছি: ‘আমি তোমাকে ভালবাসি!’ মনে পড়ছে আগে আমরা যখন এক ঘরে
থাকতাম সে সময়ের কথা। রাতে ঘুমানোর আগে আমার হাত ওর হাতে না নিয়ে ভাসিয়া ঘুমাতে
পারত না। এটা ছিল ওর অভ্যাস- ঘুমানোর সময় আমার হাত ওর হাতে নিয়েই তবে সে ঘুমাতো।
সারাটা রাত। কাজেই হাসপাতালেও আমি ওর হাতটা আমার হাতে ধরে রাখি আর কখনোই ছাড়ি না।
‘আমাদের বাচ্চাটাকে
আমার দেখার বড় সাধ হয়। ও কেমন আছে?’
‘আমরা ওর কি নাম রাখতে
যাচ্ছি?’
‘তুমি নিজেই ঠিক করো
না!’
‘আমি একা কেন ঠিক করবো
যখন দু’জনেই আছি?’
‘সেক্ষেত্রে ছেলে হলে
নাম রাখো ভাসিয়া আর মেয়ে হলে নাম রাখো নাতাশা।’
আমার কোন ধারণাই ছিল না যে
ওকে আমি কতটা ভালবাসতাম! ওকে...শুধুমাত্র ওকে। আমি যেন অন্ধের মত হয়ে গেছিলাম!
আমার হৃৎপিন্ডের নিচে ছোট একটি অস্তিত্বের দেয়া ধাক্কা পর্যন্ত টের পেতাম না। যদিও
আমার ছয় মাস চলছিল। আমি শুধু ভাবতাম যে আমার ছোট্ট বাবুটা আমার ভেতরেই আছে,
নিরাপদে আছে।
ডাক্তারদের কেউই জানত না যে
আমি ভাসিয়ার সাথে রাতে বায়ো-চেম্বারে থাকি। নার্সরা আমাকে ঢুকতে দিত। শুরুতে ওরা
আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করত: ‘কেন এসব
করছো তুমি? সে ত’ আর কোন মানুষ নেই
আসলে, একটি পারমাণবিক রি-এ্যাক্টর। একসাথে পুড়ে মরবে যে!’
তবু সেই নার্সদের রাজি করাতে ওদের পেছন পেছন কুকুরের মত দৌড়াতাম।
তাদের দরজায় আমি ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম, দয়া ভিক্ষা
আর অনুনয় বিনয় করেই চলতাম। এবং শেষে অতিষ্ঠ হয়ে তারা বলতো, ‘ঠিক
আছে! জাহান্নামে যাও! তুমি আসলে অস্বাভাবিক!’ সকাল আটটায়
ডাক্তাররা রাউন্ড শুরু করার আগে নার্সরা আমাকে এসে ইঙ্গিতে বলে দিত: ‘যাও!’ আমি তখন ডর্মে চলে যেতাম এক ঘন্টার জন্য।
তারপর আবার সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ওর মাথার কাছে। ভেতরে ঢোকার জন্য আমার
কাছে একটি পাস ছিল। হাঁটুর কাছটায় আমার পা নীল আর ফোলা হয়ে থাকত, এতটাই ক্লান্ত ছিলাম আমি।
আমি যখন ওর কাছে থাকতাম,
তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওর ছবি তুলত না- কিন্ত আমি যখন থাকতাম না,
তখন ওর ছবি তোলা হতো। ওর শরীরে কোন কাপড় রাখা হত না তখন। নগ্ন
অবস্থায়। ওর গায়ের উপর শুধু একটি পাতলা চাদর থাকত। সেই ছোট্ট চাদরটি আমি রোজ
বদলাতাম আর প্রতিদিনই সন্ধ্যা নাগাদ ঐ চাদরটা রক্তে ভরে যেত। আমি ওকে বলতাম: ‘প্রিয়! আমাকে একটু সাহায্য করো। তোমার হাত বা কনুইয়ের উপর একটু ভর দিয়ে
ওঠো, যতটা পারা যায়, আমি তোমার
বিছানাটা একটু ঠিক করে দিই, চাদরের ভাঁজগুলো একটু সমান করে
দিই।’ চাদরের সামান্য একটু ভাঁজ গায়ে লাগলেও ওর গায়ে ক্ষত
হয়। নিজের হাতের নখ আমি তখন এত ছোট করে কেটে ফেলেছি যাতে রক্ত বের হয়ে আসার দশা!
কারণ চাইতাম না আমার নখের সামান্যতম ছোঁয়ায় ওর শরীরে কেটে-ছড়ে যায়। কোন নার্সই ওর
কাছে ঘেঁষতে চাইত না। কিছু দরকার হলে ওরা আমাকে ডাকত।
আর তারা ওর ছবি তুলে রাখত।
ওদের ভাষায়- বিজ্ঞানের জন্য। সত্যি যদি ওদের সবাইকে আমি ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে
দিতে পারতাম! যদি চেঁচাতে পারতাম ওদের দিকে! আর যদি মার লাগাতে পারতাম! কি সাহস
এদের? এই মানুষটা আমার- আমার ভালবাসা- আমি যদি ওদের
সবাইকে দূরে ঠেলে দিতে পারতাম!
ওর রুম থেকে বেরিয়ে আমি
করিডোরে হাঁটছিলাম। আমি বোধ করি হাসপাতাল করিডোরে রাখা সোফাটার দিকে যাচ্ছিলাম,
কারণ ডাক্তার নার্স কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। ডিউটিতে থাকা নার্সকে
বললাম: ‘ ও মারা যাচ্ছে।’ উত্তরে নার্স
বললো, ‘তুমি কি আশা করেছিলে? ওর শরীরে
১৬০০ রোয়েন্টজেন ঢুকেছে। ৪০০ রোয়েন্টজেন কারো শরীরে ঢুকলেই আর খবর দেখতে হয় না।
তুমি ত’ একটা পারমাণবিক রিএ্যাক্টরের পাশে বসে থাকো।’
হায়, ওর সবটা মিলিয়েই যে আমার! ভাসিয়ার
বন্ধুরা সবাই যখন একে একে মারা গেল, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
হাসপাতালে কিছু সংস্কার কাজ করলো। তারা দেয়ালে সাঁটা সব জিনিষ পরিষ্কার করলো আর
ওদের রুমের কাঠের পাটাতন কেটে খুঁড়ে একাকার করলো।
আর তারপর- শেষ যা ঘটলো! আমি
যেন কোন দূর আলোর ঝলকে অতীতের সব কথা আজ মনে করতে পারি,
সব কেমন টুকরো টুকরো।
রাতে আমি ওর মাথার কাছে
আমার ছোট্ট চেয়ারটায় বসে আছি। আটটার দিকে ওকে বললাম, ‘ভাসেঙ্কা, আমি একটু হাঁটতে যাচ্ছি।’ ভাসেঙ্কা ওর চোখ খুললো এবং আবার বন্ধ করলো, আমাকে
যেতে অনুমতি দিল। আমি ডর্মে গেলাম, আমার রুমে ঢুকে সটান
মেঝেতে শুয়ে পড়লাম, বিছানার উপর শুতে পারছিলাম না, সব কিছুই কেমন যেন গায়ে ঠেকছিল, এবং তখনি
পরিচ্ছন্নতা কর্মী এক মহিলা এসে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলো, ‘যাও! ওর কাছে দৌড়ে যাও! তোমাকে পাগলের মত ডাকছে!’ পরদিন
ভোরে তানিয়া কিবেনক আমাকে ডাকছে, ‘এসো- আমার সাথে কবরখানায়
চলো। আমি একা একা সেখানে যেতে পারব না।’ ওরা সবাই মিলে
ভিতিয়া কিবেনক এবং ভলোদিয়া প্রাভিককে কবর দিচ্ছিলো। এরা সবাই ছিল আমার ভাসিয়ার
বন্ধু। আমাদের পরিবারগুলোও ছিল পারষ্পরিক বন্ধু। চেরনোবিলে বিষ্ফোরণের আগের দিনও
আমাদের ফ্ল্যাটে আমরা সব পারিবারিক বন্ধু মিলে তোলা গ্রুপ ছবি আছে। আমাদের
স্বামীরা সবাই কত সুদর্শন দেখতে! আর কত সুখী প্রত্যেকে! এটাই ছিল যেন আমাদের
জীবনের শেষ দিন! সবাই আমরা কত সুখী ছিলাম!
কবরখানা থেকে ফিরেই আমি
দায়িত্বরত নার্সকে ফোন দিলাম।
‘আমার বর কেমন আছে?’
‘সে পনেরো মিনিট আগে
মারা গেছে।’ কি? সারাটা রাত ওর পাশে
ছিলাম। মাত্র তিন ঘন্টা হয় অন্য দুই পারিবারিক বন্ধুর সৎকারে অংশ নিতে কবরখানায়
গেছিলাম। জানালার কাছে ফিরে এসে চীৎকার শুরু করলাম, ‘কেন?
কেন?’ আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে লাগলাম।
গোটা হাসপাতাল দালানের সবাই আমাকে শুনছে। আমার কাছে আসতেও তারা ভয় পাচ্ছিল। তারপর
আমি যেন সম্বিত ফিরে পেলাম: ওকে আর একবার দেখব আমি! মাত্র একবার! সিঁড়ি ভেঙ্গে
দুদ্দাড় করে নামলাম। সে তখনো তার বায়ো-চেম্বারে, তারা তাকে
তখনো সরায় নি। তাঁর বলা শেষ শব্দ দু’টো নাকি ছিল: ‘লিয়্যুশা! ল্যুসেঙ্কা!’
‘ও একটু বাইরে গেছে।
এখনি ফিরবে।’ ও নাকি তখন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে
গেছিল। এরপর আর আমি ভাসিয়াকে ফেলে কোথাও গেলাম না। ওকে কবরখানা অবধি পুরো পথ পৌঁছে
দিতে গেলাম। যদিও এখন আর কবরখানার কথা কিছু মনে পড়ে না। মনে পড়ে শুধু একটি
প্লাস্টিক ব্যাগের কথা। সেই ব্যাগটা।
মর্গে কর্তৃপক্ষের লোকরা
বললো, ‘আমরা যে তাকে পোশাক পরাবো সেটাও কি তুমি
দেখতে চাও?’ আমি রাজি হলাম। ওরা তাকে আনুষ্ঠানিক পোশাক
পরালো। চাকরিতে ডিউটিতে থাকার সময় যে টুপিটা পরতে হত, সেটিও
পরিয়ে দিল। ওর পায়ে জুতা পরানো গেল না। পা খুব ফুলে গিয়েছিল। ওর আনুষ্ঠানিক পোশাকও
কাটতে হলো কারণ আস্ত পোশাকটা পরানোর মত আস্ত একটি দেহ ওর ছিল না। যা ছিল তা’
শুধুই ক্ষত আর ঘা। শেষ দু’দিন হাসপাতালে- আমি
ওর হাতটা তুলে ধরলে ওর হাড়গুলো কাঁপত, নড়তো, আস্ত শরীরটাই যেন কঙ্কালের উপর থেকে লোপাট। ওর ফুসফুস আর পাকস্থলীর টুকরো
ওর মুখ থেকে বের হয়ে আসছিল। ওর শরীরের অভ্যন্তরীণ যত অঙ্গের যন্ত্রণায় ও তখন
হাঁসফাঁস করছিল। আমি আমার হাত ব্যান্ডেজে জড়িয়ে ওর মুখের ভেতর দিয়ে সেই যত টুকরো
টুকরো ফুসফুস আর পাকস্থলীর অংশ বের করে আনতাম। এ নিয়ে কথা বলাটাও প্রায় অসম্ভব এক
কাজ। এ সবই ত’ আমার। আমার ভালবাসার মানুষ। ওর মৃত্যুর পর ওর
পায়ে এক জোড়া জুতা পরানো গেল না। নগ্নপদ ওকে আমরা কবর দিলাম।
আমার চোখের সামনেই- ওর ঐ
আনুষ্ঠানিক পোশাকেই- হাসপাতালের লোকেরা ওকে একটি সেলোফেন ব্যাগে মুড়ে ব্যাগটির মুখ
বাঁধলো। তারপর সেই ব্যাগটি পুরে দিল একটি কাঠের কফিনে। তারপর কফিনটি পুরলো আর একটি
ব্যাগে। সেই প্লাস্টিক স্বচ্ছ হলেও পুরু ছিল। অনেকটা টেবিলক্লথের মত। তারপর এই
সবটা তারা একটা দস্তার কফিনে ঠেসে দিল। ওর দেহটা সেই দস্তার কফিনে তারা ঠেসে ঠেসে
ঢোকালো। শুধু ওর টুপিটা লাগে নি।
সবাই এসেছিলো- ওর বাবা মা,
আমার বাবা মা। মস্কোতে তারা কালো রুমাল কিনেছিল। দূর্ঘটনা কমিশন
আমাদের সাথে দেখা করেছিল। চেরনোবিল দূর্ঘটনায় নিহত সবার পরিবারকেই তারা একই কথা
বলেছে: আমাদের পক্ষে তোমাদেরকে তোমাদের স্বামী বা ছেলেদের শবদেহ ফিরিয়ে দেয়া
অসম্ভব। ওরা খুবই রেডিওএ্যাক্টিভ এবং মস্কোর কবরখানায় বিশেষ এক পন্থায় তাদের
সমাধিস্থ করা হবে। সিল গালা করা দস্তার কফিনে এবং সিমেন্টের টাইলসের নিচে। তারা
রাষ্ট্রের বীর। তারা রাষ্ট্রের সম্পদ।
আমরা কবরখানায় যাবার গাড়িতে
বসে ছিলাম।
মৃতের আত্মীয়-স্বজন আর কিছু সামরিক ব্যক্তি। একজন কর্ণেল এবং তাঁর
রেজিমেন্ট। তাঁরা রেজিমেন্টকে বলছিলেন, ‘তোমাদের নির্দেশের
অপেক্ষা করছে!’ মস্কোর হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি প্রায় দুই কি
তিন ঘণ্টা ছুটতে থাকে। এরপর আমরা আমার মস্কোতে ফিরতে থাকি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
রেজিমেন্টের সৈন্যদের বলে: ‘কবরখানায় আমরা কাউকে ঢোকার
অনুমিত দিচ্ছি না। দু’জন বিদেশী প্রতিবেদক কবরখানায় হামলা
করছে। কাজেই খানিকটা সময় অপেক্ষা করো।’ আমাদের বাবা-মায়েরা
কোন কথা বলছিল না। মা’র ছিল একটি কালো রুমাল। আমার মাথা
খারাপ হয়ে যাচ্ছিল: ‘ওরা কেন আমার স্বামীকে লুকোচ্ছে?
সে কি ছিল? সে কি মানুষ খুন করেছিল? নাকি অপরাধী? আমরা কাকে কবর দিচ্ছি?’ আমার মা বললেন, ‘চুপ! চুপ র্ক মেয়ে!’ মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কর্ণেল হাঁক দিলেন, ‘চলো বরং আমরা কবরখানায় ঢুকি। বিধবা বউটির হিস্টেরিয়া দেখা দিচ্ছে।’
কবরখানায় আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকলো সৈন্যরা। আমাদের সাথে সৈন্যদের
একটি সাঁজোয়া
গাড়ি ছিল। গাড়িটি কফিনটা বহন করছিল। কবরখানায় কাউকেই ভেতরে ঢুকতে
দেয়া হলো না। শুধু আমরা ক’জনা। ওরা তাকে এক মিনিটের ভেতর
মাটিতে ঢেকে দিল। ‘তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!’ অফিসার চিৎকার করছিলেন। তারা আমাকে এমনকি কফিনটা একবার আলিঙ্গন করতে
পর্যন্ত দিল না। এবং- তারপর সবাইকে আবার বাসে উঠতে হলো। সবকিছুই হলো গোপণে,
সন্তর্পণে।
তারপর খুব দ্রুতই আমাদের
বাড়ি ফেরার জন্য বিমানের টিকিট কেটে দেয়া হলো। পরের দিনই। সারাটা সময় আমাদের সাথে
কর্তৃপক্ষের একজন ছিল। আমাদের সাথে থাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তি এমনকি
যাত্রাপথে আমাদের খাবার জন্য কিছু কিনতে ডর্মের বাইরে যেতে পর্যন্ত দিল না। যেন
আমরা বাইরের কারো সাথে কথা বলতে না পারি- বিশেষ করে আমি। যেন বা তখন আমার কথা বলার
শক্তি ছিল! আমি তখন কাঁদতেও পারছিলাম না। আমরা যখন মস্কো ছাড়িছলাম,
ডিউটিতে থাকা নারীটি ভাসিয়ার ব্যবহার করা সব তোয়ালে এবং চাদরগুলো
গুণছিল। সে সেগুলো ঠিকঠাক ভাঁজ করে একটি পলিথিন ব্যাগে রেখে দিল। সম্ভবত: তারা
ভাসিয়ার ব্যবহার করা চাদর আর তোয়ালে সব পুড়িয়ে ফেলেছিল। ডরমিটরিতে আমার থাকার বিল
আমরাই শোধ করলাম। চোদ্দ রাতের বিল। এটি পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়াজনিত বিষক্রিয়া
আরোগ্যের হাসপাতাল। সেখানে চোদ্দটি রাত কেটেছে আমার। একজন মানুষ মরতে কত দীর্ঘ সময়
না নেয়- এতটা কষ্ট পেয়ে!
মস্কো থেকে বাড়ি ফিরে আমি
ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর টানা তিন দিন নাকি
ঘুমিয়েছিলাম। একটি এ্যাম্বুলেন্স এসেছিল আমাকে নিতে। ‘না,’ ডাক্তার বলেছিলেন, ‘ও
জাগবে। ও ভয়ানক ঘুম ঘুমোচ্ছে।’
আমার বয়স তখন তেইশ।
সেসময় ঘুমের ভেতর যে
স্বপ্নটি দেখেছিলাম তা’ আজো মনে করতে পারি।
আমার মৃত মাতামহীকে যে পোশাকে আমরা কবর দিয়েছিলাম সেই পোশাক পরে তিনি আমার কাছে
এসেছেন। নতুন বছরের গাছ সাজাচ্ছেন। ‘দিদা, আমরা কেন এখন নতুন বছরের গাছ সাজাচ্ছি? এখন ত’
গ্রীষ্মকাল।’
‘কারণ তোমার ভাসেঙ্কা
দ্রুতই আমার সাথে যোগ দেবে।’ এবং ভাসেঙ্কা যেন বনে দিন কাটাচ্ছে। তারপর আবার যে স্বপ্ন দেখলাম- ভাসিয়া
একটি সাদা পোশাকে আমার কাছ এসে নাতাশাকে ডাকছে। আমাদের যে কন্যা সন্তানকে আমি এখনো
জন্ম দিই নি। অথচ স্বপ্নে সেই নাতাশা দিব্যি বড়। ওর বাবা ওকে সিলিং অবধি ছুঁড়ে
আবার লুফে নিচ্ছে আর বাবা-মেয়ে দু’জনেই মিলে হাসছে। আমি ওদের
দেখছি আর ভাবছি এটাই বোধ হয় সুখ- কত সহজ আর স্বাভাবিক! আমি ঘুমোচ্চি। আমরা জলের
কাছে হাঁটছি। হাঁটছি আর হাঁটছি। সে আমাকে বোধ করি কাঁদতে মানা করছিল। আমাকে কি
জানি একটি ইঙ্গিত করলো। সেখান থেকেই।
(বিধবা মেয়েটি আবার
নীরব হয়ে যায়, দীর্ঘ সময়ের জন্য)।
দু’মাস পর আমি আবার মস্কো গেলাম। রেল স্টেশন থেকে আবার সরাসরি কবরখানায়। ওর
কাছে! এবং কবরখানাতেই আমার প্রসব বেদনা উঠলো। ওর কবরের কাছে গিয়ে যেই না ওর সাথে
কথা বলতে শুরু করেছি- আশপাশের সবাই এ্যাম্বুলেন্স ডাকলো। সেই এ্যাঞ্জেলিনা
ভাসিলিয়েভনা গুস্কোভার হাতেই আমার সন্তানের জন্ম হলো। উনি আমাকে আগেই বলেছিলেন: ‘তোমাকে এখানে প্রসবের জন্য আবার আসতে হবে।’ আমার
ব্যথা উঠলো নির্দিষ্ট সময়ের দু’সপ্তাহ আগেই।
হাসপাতালের সবাই আমাকে আমার
বাচ্চাটিকে দেখালো- একটি মেয়ে। ‘নাতাশেঙ্কা,’
আমি তাকে ডাকলাম, ‘তোমার বাবা তোমার নাম
রেখেছিল নাতাশেঙ্কা।’ নাতাশার স্বাস্থ্য বেশ ভালই হয়েছে। হাত,
পাগুলো বেশ গোলগাল। কিন্ত ওর লিভার সিরোসিস আছে। ওর লিভারে আঠাশ
রোয়েন্টজেন তেজষ্ক্রিয়তা ধরা পড়লো। সেই সাথে জন্মগত হৃদরোগ। চার ঘন্টা পরেই
হাসপাতালের সবাই আমাকে জানালো ও মারা গেছে। তারপর সেই একই কাহিনী: আমরা তোমাকে
তোমার বাচ্চাটা দেব না! এর মানে কি যে তোমরা ওকে আমার কাছে দেবে না? বরং আমি ওর মা- আমি ওকে তোমাদের কাছে দেব না! তোমরা তাকে বিজ্ঞানের জন্য
নিতে চাও? আমি ঘৃণা করি তোমাদের বিজ্ঞান! ঘৃণা করি!’
(নীরবতা) ।
তোমাদের কাছে আমি কত না
ভুলভাল বকছি! আমার স্ট্রোকের পর থেকে আমার ত’ চীৎকার করা মানা। আমার কান্নাকাটি করাও নিষেধ। এজন্যই কথা বলাও ঠিক না।
তবু আমি এসব কথা সবাইকে বলব। কেউ ত’ জানে না এসব। হাসপাতালের
লোকেরা এরপর একটি ছোট কাঠের বাক্স আমার কাছে নিয়ে এসে বলেলো, ‘তোমার এই বাক্সটির ভেতর আছে।’ তাকিয়ে দেখলাম ওকে
পোড়ানো হয়েছে। আমার ছোট্ট মেয়েটা এক তাল ছাই। আমি কান্না শুরু করলাম, ‘ওকে ওর বাবার পায়ের কাছে ফেলে দাও।’ মিনতি করলাম।
সেখানে- মানে ঐ কবরখানায়
আমার মেয়েটির নামে অর্থাৎ নাতাশা ইগনাতেঙ্কো নামে কোন ফলক নেই। শুধু ওর বাবার নাম
আছে। নাম রাখার আগেই ত’ ও মরে গেল। জন্মেই
চলে গেল- পৃথিবীতে কিচ্ছু পেল না সে! শুধুই একটি আত্মা। এভাবেই মেয়েটাকে সেখানে
কবর দিলাম। সেখানে আমি গেলে সবসময় দু’টো ফুলের তোড়া নিয়ে
যাই: একটি তার জন্য আর একটি পাশেই এক কোণায় ভাসিয়া আর আমার মেয়ের জন্য। কবরের
চারপাশ হাঁটু মুড়ে আমি ঘুরি। সবসময় হাঁটু মুড়ে ঘুরি (কথা বোঝা যায় না)। আমিই আমার
মেয়েকে খুন করেছি। আমি। তাকে। রক্ষা করেছে। আমার ছোট মেয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। সে
সব তেজষ্ক্রিয়তা নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। ও যেন ছিল একটি আলোর শলাকা
যে সব তেজষ্ক্রিয়তা শুষে নিয়েছে। এত ছোট্ট ছিল। একটি ছোট্ট, পলকা
প্রাণ (সাক্ষাৎকারদাত্রী এবার কথা বলতে গিয়ে শ্বাস টানতে থাকেন)।
আমার ছোট মেয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে...কিন্ত আমি ওদের ভালবাসতাম।
ওদের দু’জনকেই। কারণ- কারণ ভালবেসে কাউকে তুমি মারতে পার না,
ঠিক ত’? এতটা ভালবেসে কাউকে হত্যা করা যায় না!
কেন এই দু’টো জিনিষ একসাথে আসে- ভালবাসা এবং মৃত্যু? একসাথে আসে? কে আমাকে এটা ব্যখ্যা করবে? আমি কবরের পাশে হাঁটু মুড়ে হামাগুড়ি দিই।
(দীর্ঘ সময় নীরবতা)।
কিয়েভে সরকার থেকে আমাকে
একটি এ্যাপার্টমেন্ট দিল। এটি ছিল একটি বড় দালান যেখানে আণবিক স্টেশনের সবাইকে,
নিহতদের পরিবার পরিজনকে তারা জায়গা দিল। আমার এ্যাপার্টমেন্টে বেশ
জায়গা আছে। দুই কামরার ঘর। যেমন একটি ঘরের স্বপ্ন আমি আর ভাসিয়া দেখতাম। আর একা
আমার সেই এ্যাপার্টমেন্টে থেকে পাগল পাগল লাগত!
ধীরে ধীরে আমার জীবনে নতুন
আর একজন এলো। আমার নতুন স্বামী। তাকে আমি সব কিছু বললাম- গোটা সত্য- যে আমার জীবনে
একমাত্র প্রেম কে ছিল? আমার সমগ্র জীবনে! এই
নতুন মানুষটির সাথে আমি দেখা করতাম। তবে তাকে কখনো আমার বাসায় ডাকি নি, যেখানে আগে ভাসিয়া আমার সাথে থাকত।
আমি একটি চকোলেটের দোকানে
কাজ করতাম। হয়তো দোকানে বসে কেক বানাচ্ছি অথচ আমার গাল গড়িয়ে জল নামছে। আমি কাঁদছি
না, তবে চোখ বেয়ে জল নামছে।
একটি ছেলে হলো আমার,
আন্দ্রেই। আন্দ্রেইকা। আমার বন্ধুরা আমাকে থামাতে চাইলো, ‘তুমি একটি বাচ্চা নিতে পারো না।’ আর ডাক্তাররাও
আমাকে ভয় দেখাতে চাইলো, ‘তোমার শরীর এতটা বইতে পারবে না।’
তারপর- বেশ কিছুটা সময় পরে ডাক্তারেরা জানালো ওর একটা হাত হবে না।
ডান হাত। ডাক্তারি যন্ত্রপাতি দিয়ে সেটা তারা আমাকে দেখালো। ‘না-ই বা হলো ডান হাত! আমি ওকে বাম হাতে লিখতে শেখাব।’ কিন্ত বাচ্চাটা সুন্দর বের হলো। মিষ্টি দেখতে। এখন সে স্কুলে, ভাল নম্বর পায়। এখন আমার কেউ আছে- যার সাথে আমি বাস করতে পারি, শ্বাস নিতে পারি। ও আমার জীবনের আলো। সে সবকিছু খুব সুন্দর আর নিখুঁত ভাবে
বুঝতে পারে। ‘মা, আমি যদি দিদার কাছে
দু’দিনের জন্য বেড়াতে যাই, তুমি কি
শ্বাস নিতে পারবে?’ না, পারব না! যেদিন
আমার ছেলেকে ছেড়ে আমার থাকতে হবে, সেদিন আমি শ্বাস নিতে পারব
না। একদিন আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি যেন পড়ে যাচ্ছি।
এটাই ছিল আমার প্রথম স্ট্রোক। রাস্তার উপরেই। ‘মা, তোমার কি একটু জল লাগবে?’ ‘না, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাক। কোথাও যেও না।’ এটুকু বলে
আমি আমার ছেলের হাত আঁকড়ে ধরলাম। এরপর কি হলো তা’ আর আমার
মনে নেই। হাসপাতালে এলাম। আমি আমার ছেলেকে এত শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরলাম যে ওর হাত
থেকে আমার আঙুলগুলো ছাড়াতে ডাক্তারদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ওর হাত বেশ লম্বা সময়
ধরে নীল ছিল। এরপর এখন যখন আমরা ঘর থেকে বের হই, ও আমাকে
বলে: ‘মা, আমার হাত অত জোরে ধরো না!
আমি কোথাও যাব না।’ সে খুব অসুস্থও: দু’সপ্তাহ স্কুলে কাটায় ত’ দু’সপ্তাহ
বাসায় ডাক্তারের সাথে থাকে। এভাবেই আমরা বাঁচি।
(বিধবা নারীটি উঠে
দাঁড়ায়, জানালার কাছে যায়)।
এখানে আমাদের অনেকেই আছে।
একটি গোটা সড়ক। সড়কটিকে সবাই ডাকে- চেরনোবিলস্কায়া। এই মানুষগুলো পরমাণু স্টেশনে
গোটা জীবনটা কাজ করেছে। আজো কেউ কেউ সেখানে কাজ করতে যায়,
তবে চেরনোবিলে কেউ আর বাস করে না। সবারই নানা বাজে রোগ আছে, পঙ্গু হয়ে গেছে তারা, তবু তারা তাদের চাকরি ছাড়ে না।
রিএ্যাক্টর বন্ধ হবার কথা শুনলেও ভয় পায়। এখন অন্য কোথায় কে তাদের কাজ দেবে?
প্রায়ই তারা মারা যায়। এক মূহুর্তের ভেতরে হুট করে জীবনাবসান হয়
তাদের। ঝপ করে পড়ে যায় তারা- হয়তো কেউ হাঁটছে, হাঁটতে
হাঁটতেই পড়ে গেল, তলিয়ে গেল ঘুমে, যে
ঘুম থেকে সে আর জেগে ওঠে না। সে হয়তো তার নার্সের জন্য ফুল আনছিল এবং হঠাৎই তার
হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে চেরনোবিলের তেজষ্ক্রিয়াগ্রস্থ কত মানুষ
নীরবে মারা যায় বা আজো যাচ্ছে, কিন্ত কেউই আমাদের হাল হকিকত
কিছু জানতে চায় নি। কেউ জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি যে আমরা কিসবের ভেতর দিয়ে এতগুলো
বছর ধরে গেছি। আমরা কি দেখেছি। কেউ ত’ আসলে মৃত্যু সম্পর্কে
কিছু শুনতে চায় না। জানতে চায় না সেসব বিষয় যা শুনলে মানুষ ভয় পায়।
কিন্ত আমি তোমাকে আমার
প্রেমের বিষয়ে বলছিলাম। আমার প্রেম...
ল্যুদমিলা ইগনাতেঙ্কো,
মৃত অগ্নি নির্বাপণকর্মী ভাসিলি ইগনাতেঙ্কোর বিধবা স্ত্রী
No comments:
Post a Comment