উপল বড়ুয়া


মহাথের

ভোর চারটায় উ. জ্যোতির্ময় মহাথের বুদ্ধের তিনবার নাম জপ করে শরীর হতে গেরুয়া চাদরটা আস্তে আস্তে খুলে ফেলেন। পৃথিবী তখন একষট্টি বারের মতোন পাশ ফিরছে। মহাথের রাত্রে বানিয়ে রাখা চিরতার পানি দুই ঢোকে শেষ করে পুনরায় বুদ্ধকে ডাকেন। জগতের সমস্ত দুঃখ ও আবর্জনা তিনি সইতে পারেন কেবল চিরতার জল ছাড়া। তবু তাঁকে এই কঠিন কাজটি প্রতিনিয়ত করে যেতে হচ্ছে। পূর্বজন্মের পাপের ফল স্বরূপ এবং পেট ঠিক রাখার জন্য। গতরাতের জ্বালানো মোম ও আগরবাতির সুগন্ধ তখনও বিহারে ভাসছে। চারদিকে ঘন ঝাপসা কুয়াশা। শীতে কাবু গ্রাম জাগানোর জন্য তিনি দুইশ বছরের পুরনো পিতলের ঘন্টায় তিনবার আওয়াজ তুলেন। যেন ঢং আওয়াজ থেকে পৃথিবীর পুনঃজন্ম হচ্ছে। তারপর ধীরস্থির পায়ে মনে মনে বুদ্ধবন্দনা করে মহাথের প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটাতে ঢুকে পড়েন ল্যাট্রিনে। মুন্ডিত মস্তকের অনাথ শীতার্ত শ্রামণেরা তখন নিজেদেরকে আরও জোরে সযত্নে মুড়িয়ে ফেলে লাল কম্বলে। চারশ বছরের পুরনো বিহার; দরজার সামনে পাহারারত হা করা পাথরের দুই সিংহমূর্তির ফাঁক গলে; সিংহশয্যায় শায়িত গৌতমের নির্লিপ্ত চোখ উপেক্ষা করে; বার্মিজ নকশা আঁকা জানলার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে হিমবায়ু। হঠাৎ দুয়েকটা আশ্রিত কবুতরের ঘুমস্বর ও ডানা ঝাপটানোর শব্দ শেষ হতেই হুলো বেড়ালটা চারবার মিউ সুরে হাই তুলে চুপসে যায়। গতরাতে শ্রামণগণ শীত পোহানোর জন্য মরা আম কাঠের ডাল ভেঙে আগুন জ্বালিয়েছিল। সেই অগ্নিকুন্ডলীর চারপাশে চারটে নেড়ি কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। চাপকল থেকে মহাথেরর গলা খাঁকারি ও ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে অরহং সম্যক সম্বুদ্ধ, বীর্য্যচরণ সম্পন্ন, সুগতো লোকবিদু গেরুয়া চীবর খুলে এবার তিনি গুণে গুণে গায়ে তিনবালতি জল ঢেলে স্নান সারেন।  

প্রথম বালতি জল ঢালার পূর্বে বলেন— ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। 

দ্বিতীয় বালতি জল ঢালার পূর্বে বলেন— ‘ধম্মং শরণং গচ্ছামি। 

তৃতীয় বালতি জল ঢালার পূর্বে বলেন— ‘সংঘং শরণং গচ্ছামি।  

তখনঅব্দি শান্ত ও পবিত্র পৃথিবী, নারিকেল ডালে বোনা বাসা থেকে কয়েকটি বাবুই পাখির শব্দ দিয়ে কাজ সারছে। সৌম্যকান্তির উ. জ্যোতির্ময় মহাথের; বয়েস যাঁর মাত্র একশ দশ ছুঁই ছুঁই, চক্রমণের উদ্দেশ্যে এসে দাঁড়ায় বোধিতরু তলে। পৃথিবী ঘুরছে, জগৎ অনিত্য, যাহা উদয় তাহায় অস্ত যায়এই জ্ঞানে ধীরপদে বোধিতরুকে কেন্দ্র করে শুরু করেন চক্রমণ। ক্ষান্তিমান, স্নিগ্ধকান্তির মহাথের চক্রমণ শেষে চোখ তুলে কয়েকমিনিট জগতের দিকে নিক্ষেপ করেন দৃষ্টি। কয়েকটি নক্ষত্রকে আঙুলের ইশারা দিতে ‍গিয়ে তাঁর অস্ফুট স্বর থেকে ভেসে আসে দুর্বিবাক, দুর্বিবাক, দুর্বিবাক…’

পৃথিবী তখন ফর্সা হতে শুরু করেছে। মহাথের ভাঙাস্বরে তিনবার জাগো ধ্বনি করতেই পাহাড়ের ভেতর থেকে ঘুমঘুম চোখে মুখ বেঁকিয়ে হাই তুলে সুর্য্যদেওতা। স্থির মহাথের তাঁর কুচকানো গালে হাসেন একবার। ঘোলা চোখে ভ্রু কুঞ্চণ করে মহাথের শরীর কাঁপিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন অল্প। বোধিতরুর দিকে চোখ ফিরিয়ে তিনি পাতাদের উদ্দেশ্যে তিনবার ফুঁ দিতেই পাতারা ঝংকার তুলে কাঁপতে কাঁপতে একটি সুমিষ্ট শীতল বায়ু বয়ে দেয় জগতে। পুনশ্চঃ তিনি দুহাত জোড় করে ডুবে যাবেন বুদ্ধস্মৃতিতে। সমাধির শেষ স্তরের দিকে আসতেই জগতের তির্যককুলের চিৎকারগোলযোগে তাঁর ধ্যান হয়ে যায় চুরমার। তবু ক্ষান্তিবাদী মহাথের যিনি কখনও রাগেন না; সামান্য অহংকারও নড়াতে পারে না যাঁকে; মনুষ্য তথা জীবকুলকে মৈত্রী দান করেন। বলেন সব্বে সত্ত্বা সুখিতা ভবন্তু

ধ্যান শেষে মহাথের বিহারের চারপাশে ঘুরে ঘুরে গাছেদের গায়ে হাত বুলাতে থাকেন। কুশল জিজ্ঞাসা করেন সবার। কয়েকজন পূজারির পায়ের আওয়াজ নিয়ে আসে সকালের বার্তা। মহাথের জানেন, তিনি ছোঁয়াইং খেয়ে উঠতেই পৃথিবী ডুবে যাবে মিথ্যা, চুরি, কাম, সুরার পাপাচারে। তবু এসব অপায় থেকে মানব জাতিকে রক্ষার জন্য নিবেদিত মহাথের সারাদিন বুদ্ধকে ডেকে যাবেন। বুদ্ধ গুণ অনন্ত  আকাশের দিকে চোখ তাক করে, স্মিতহাস্যে তিনি অনর্গল কথা বলে যাবেন অদৃশ্য ব্রহ্মচারী গুরু ও দেবতাদের সাথে। ইশারা ভাষায়।

মহাথের 

মহাথের দুবার মাথা নাড়েন সামনে ঝুঁকে।  

পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যেতে আর দেরি নেই। 

মহাথের দুবার চোখের পাতা ফেলেন।  

সামনের বৎসর তুমি আরেকটা চৈত্য নির্মাণ করো উত্তরের পাহাড়ে। 

মহাথের অনড়।  

বর্ষাবাসের আগে পাঁচশ ভিক্ষু নিয়ে আরেকটা মহাসংগীতির আয়োজন করো। 

মহাথের দুহাত সামনে তুলে করজোড় করেন। 

বিহার আক্রমন হবে আরও দুবার। সাবধানে থেকো। 

মহাথের দূরে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকেন। নিঃশব্দে।   

 

গত শতাব্দীর শুরুতে যখন পৃথিবী একটি অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল; (মহাথেরর মতে। মহাথের এসব প্রতিজনে বলেন)মানুষ ভুলে যাচ্ছিল সম্যকসম্বুদ্ধের নাম তখন এক ঘোরতর বন্যায় ডুবে গিয়েছিল রাজারকুল গ্রাম। মহাথের তখন ছোট্ট শিশু। পলাতক এক বন্য ষাঁড়ের লেজে ঝুলে টানা সতের কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। তারপর সুউচ্চ এক পাহাড়ের গুহায় টানা এগারো বছর পাহাড়ী ছড়ার জল ও বন্য কলা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন একটি বাক্যও ব্যয় না করে। বহু বছর আগে খাকী পোশাকের কিছু অস্ত্রধারী মানুষ যখন তছনছ করছিল মেঘডুমুর বন আর মায়াহরিণের সংখ্যা কমে আসছিল ধীরে তখন তিনি নেমে আসেন সমতলে। এই বিমূর্তভাবনা বিহারে।

পূজারিরা মহাথেরকে দেখে হাঁটু গেড়ে বসে করজোড়ে জানায় প্রণাম। তিনি তাদেরকে কেবল বলেন সুখি হও। মানবজীবন অত্যন্ত কঠিন। অশেষ পূণ্যের ফল। পূজারিদের মাথা আরও বেশি করে তাঁর পায়ের সাথে দেবে যায়। অবিচলিত মহাথের মনে মনে ভাবেন নিজেকে আগামী কঠিন চীবর দান পর্য্যন্ত টিকিয়ে রাখার। বহুদিন মৃত্যু পায়ের কাছে গুনগুন করর পরও তিনি মৃত্যুকে স্থগিত করে রেখেছেন আপাতত। এই যে গ্রামের মানুষজন, যাদেরকে তিনি আর্শীবাদের ভেতর দিয়ে জিইয়ে রেখেছেন, যদি তিনি দেহকে আকাশমার্গে উৎক্ষিপ্ত করেন তবে এইসব মানুষজন আশাহীন ও ভ্রান্তিতে পর্য্যবসিত হবে। তিনি জানেন, প্রতিদিন কয়েক শত লোক তাঁর চুল দেখার জন্য হলেও বিহারে আসেন। যদিও আজতক তা কেউ দেখেনি। দুপুর ভোজনের আগে তিনি সাবান ঘষে মুন্ডিত মস্তক ব্লেডে ঘষে আরও ধবধবে ও চকচকে করেন। তিনি জানেন, পৃথিবীর কোন প্রান্তে প্রতিমুহুর্তে কী ঘটছে। কখন যুদ্ধ শুরু হচ্ছে ও থামছে। বহমান বাঁকখালী নদী আগামী আটত্রিশ বছর পর কোনদিকে মোড় নিবে আর কী নাম ধারণ করবমহাথের সব জানেন। পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষের ডাকনাম ও তাদের জন্ম জন্মান্তরের ইতিহাস তিনি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারেন। তবু তিনি বলবেন না। এবং এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা তিনি কাউকে জানতে দেন না। পতঙ্গেরা যেমন আগুনে মুগ্ধ হয়ে আগুনের কাছে আত্মহুতি দেয়; তেমনি গ্রামের লোক, দূর-দূরান্তের লোক এসে তাঁর কাছে নতজানু হয়। ভবিষ্যৎ জানার আশায় বসে থাকে। তিনি কেবল তাদের দেখে মাত্র একটি বাক্যেই কাজ সেরে ফেলেন— “পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো?” মানুষের গোলযোগ উঠে, “প্রভু, এই মানবজীবনের উদ্দেশ্য কী?” মহাথের চুপ করে থাকেন। মহাথের কিঞ্চিৎ হাসেন। তিনি জানেন সবকিছু আগের মতোই ঘটছে। পুনরাবৃত্তি হচ্ছে ইতিহাস। কয়েকলক্ষ বছর আগের দীপংকর বুদ্ধের জীবন যেমন ছিল ঠিক একই জীবন পালন করেছেন গৌতম বুদ্ধ, ঠিক একই জীবন পালন করে যাবেন আগামীর রাম বুদ্ধঠিক একই প্রশ্ন ভিক্ষু আনন্দ, গৌতম বুদ্ধকে করেছিল। একই প্রশ্ন করা হবে রাম বুদ্ধকে। গুহাতে ধ্যানের সময় এক কাঠুরে তাঁকে একই প্রশ্ন করেছিল আর আজও তাকে একই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। একই উত্তর তাকে দিতে হবে বারবার। তিনি জানেন, পৃথিবীর প্রতিটি ধুলি-কণা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের যা সামান্য ধুলি তা হাজার বছর পর পর্বতে রূপ নেবে। আজকের যে সামান্য ধুলি, হাজার হাজার বছর আগে সেই ধুলি হয়তো ছিল কোন বিশাল পাহাড়ের অংশ। তিনি জানেন, মুক্তির জন্য হেতুকে ধ্বংস করতে হবে। তিনি জানেন, হেতু থেকেই দুঃখের উৎপত্তি।

দিন বেড়ে যাচ্ছে। রাত বেড়ে যাচ্ছে। জোয়ার ভাটা হচ্ছে। ‍প্রতিটি রাতের মতোন, অভ্যেসবশত তিনি বুদ্ধনাম জপে ধ্যানে বসবেন। আকাশে চাঁদ দেখা যায়। তিনি জানেন, চাঁদ আলোধারকারী উপগ্রহ মাত্র এক। তাহার আলোতে তিনি মুগ্ধ হবেন না। দূরে এক মাতাল গায়ক তার সুরেলা গানে ভেঙে দিচ্ছে রাত। মহাথের তাতে বিচলিত হবেন না একদম। মেঘ ডাকছে। বিজলি চমকাচ্ছে। বৃষ্টির আভাসে কেঁপে উঠেছে পাখিদের বাসা। মহাথের এই সামান্যতে ভয় পাওয়ার পাত্র নয়। একটি মেয়ের নাকিসুরের কান্না আর গোঙানি শোনা যাচ্ছে। কোন দুঃশ্চরিত্র লোক হয়তো তাকে ফুঁসলিয়ে ভোগ করছে। মহাথের জানেন, এখন তার মন উতলা হওয়ার সময় নয়। মাংস রান্নার সুঘ্রাণ চতুদ্দিসে ভেসে আসছে কোন গৃহস্থ বাড়ি থেকে। এসব ঘ্রাণে তিনি নাক ডুবাতে রাজি নয়। রাত ঘন হচ্ছে। সময় ঘোরতর আর তাঁর ধ্যান গভীর থেকে গভীর। নাসাগ্র ছাড়া এখন তাঁর স্মৃতি নেই কোথাও। মহাথের জানেন, সমাধির শেষ স্তরে আসার আগেই পৃথিবীর তির্যককুলের চিৎকারগোলযোগে তাঁর ধ্যান হয়ে যাবে চুরমার। ভোর হতেই গতকালকের পূজারিরাই আজ তাঁকে দিতে আসবে ছোঁয়াইং। আগামীকালও তারা আসবে। একই জীবন পালন ও প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবেন তিনি উপাসকদের। তিনি ক্লান্ত হতে চেয়েও পারবেন না। আগামীকালকের জন্য তাঁকে তাঁর শরীর টিকিয়ে রাখতে হবে। তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভাববেন, সিদ্ধার্থ ছয় বছর কঠোর সাধনা করার পর মাত্র একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পেরেছিলেন। আর তা হলোএভাবে হবে না তিনি জানেন, সব উদয়-অস্ত। পৃথিবী একটি চক্রব্যুহ। সময়ভেদে বস্তু আর প্রাণীরা কেবল রূপ পাল্টাচ্ছে। এর বেশী কিছু নয়। একসময় পৃথিবীতে মাছেরা শাসন করতো। পরে ডাইনোসর শাসন। এখন মানবজাতির। অন্য একসময় হয়তো অন্য কোন উচ্চতর জ্ঞানী প্রাণ বা উদ্ভিদ পৃথিবীর কোলে বেঁচে থাকবে। মহাথের এসব জানেন তবে কাউকে জানান না।



2 comments:

  1. Upal darun lekha bhai...santo samahito..o sundar...porar por kichhukhan chup kore thakte bhalo lage...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ভাই। ভাল লাগছে শুনে আমার নিজেরেই মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। ভাল থাকবেন।

      Delete