অনাবিল মুখোপাধ্যায়


সেলুন 



কবির মতামত অনুযায়ী, যেভাবে কেউ কেউ কবি হয়ে উঠতে পারেন, সেভাবেই কিছু কিছু ছবিই পূর্নাঙ্গিক আকার নেয় এবং অবশ্যই কেউ পরিচালক হয়ে উঠতে পারেন।আমি আবার বেড়ে ওঠা, ছোট হওয়া,বচন ভঙ্গি, চাউনি, খিস্তি দেওয়া, দৌড়ানো সবকিছুর  কৃতজ্ঞতা ও দায় সিনেমাকে দিয়েছি। তাই বেঞ্জামিন বাটনের জন্ম থেকে ইন্দির ঠাকরুনের মধ্যেকার পুরোটাই সিনেমা এবং বাকি ফেড ইন ফেড আউটের কুয়াশায় অনেকটা ভালোবাসা তাপ নিয়েছে ছোটবেলা থেকে।কলজজীবনের প্রথম বছরে ছবি করার সিদ্ধান্ত নিই এবং স্বাভাবিক ভাবে প্রথম ছবির গল্প, নায়িকা, চরিত্র, শুরু, শেষ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর, তা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার চাপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।অতএব কিছু ছবি মরে যায়, একা একা।

Fade in...


দীর্ঘসময়ের দীর্ঘসূত্রতার পরে, আমার হাতে শীতকালের এক দুপুরে, এসে পড়ে, সুন্দর প্রচ্ছদযুক্ত, আয়তনে সামান্য এবং রোগা একখানা বই, নাম গদ্যলেন।নামের ভিতর কেমন একটা খয়েরী রঙের মায়া ছিলো, একটা আন্ডার ডগের কথা ছিলো, আর অনেক অগোছালো উপেক্ষা করা ডিটেইলিং।এভাবেই, অনেক গল্পের মধ্যে, সম্বিত বসুর "সেলুন" শিরোনামধর্মী গল্পটা পড়তে গিয়ে, প্রথম লাইনে হোঁচট খেয়ে, নিজেকে প্রশ্ন করতে গিয়ে, উত্তর পাই এবং সেই উত্তরই আমার ছবির নায়ক হয়ে উঠেছে। 'সেলুন' একটা মিনি ভারতবর্ষ দিয়ে শুরু করা গদ্যে কাঁচি চলতে পারে, এই ভয়ে প্রথমেই ছবি লেখা শুরু করিনি। ছবিটা লেখা শুরু করি সমসাময়িক দেশজ কান্ডকারখানাকে চাক্ষুষ করার কিছুদিন পর। এপ্রিল মাসের এক সকালে চরিত্রদের তৈরি করে পরের দিন সামান্য তথ্যসংগ্রহ করে চিত্রনাট্যের সমাপ্তি ঘটে। বলাই বাহুল্য ছোট ছবির প্রযোজক পাওয়ার থেকে দুপুরে ডাকাতি করা ভালো, কিন্তু চওড়া কপালের জোরে সমর্পিতা চন্দ আর সোমনাথ দাসগুপ্তের মত সাহসী প্রযোজক পেতে আমায় একটি দিনও দরজাই ঘোরার নিয়তি পেতে হয়নি। ফেসবুকের একটা টোকায় সদয় হওয়া, এই দুটো মানুষের জন্যই, নিজের মত করে ছবিটা শেষ করতে পেরেছি, নিজের মত করে।


Dissolve...

সেলুন একটা আপাদমস্তক সাহসী ছবি, যার জন্ম লগ্ন থেকে আমি জানতাম ছবির পরিণতির কথা। ছবির কোনো জাত নেই, সিনেমা ভালো কিম্বা সিনেমা খারাপ এই ধারণায় বিশ্বাসী হলেও, ছবি করতে গিয়ে বুঝেছি, ছোট ছবির ধরন একদম আলাদা। আর নিজের গুণ ও বৈশিষ্ট্যে ছোট ছবির চেয়ে বড় মাধ্যম পৃথিবীতে এখনো আসেনি। অতএব ঘটক বাবু এই যুগে বড় ছবির খুব কটা সাহায্য নিতেন না বলে মনে করি।
ছবির লেখনী অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। একধরনের ছবি থাকে , যার মোচড় এবং গল্পের শিরদাঁড়া শক্ত হওয়ায় পুরো ছবিটা গল্প নির্ভর হয়ে ওঠে, যেখান চিত্রনাট্য একটি সাঁকো মাত্র। আরেকধরনের ছবিতে গল্প ন্যুব্জ হলেও ঘামঝরানো চিত্রনাট্যের দৌড়ঝাঁপে মাঝগঙ্গায় ছবি পার করে ফেলে। "সেলুন" প্রথম গোত্রের ছবি, এই ছবিতে ছবির গল্পই নায়ক।


Cut to...

ছবি শুরুর আগে শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম, মন জুড়ে মনখারাপ হয়ে রয়েছে, এদিকে প্রীতম আর রোহিতের সাথে অগুন্তি রিহার্সাল দিয়ে ফেলেছি। ওরাও হাপুস নয়নে অনেকটা আশা নিয়ে করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এরকম ঝড়ের সময় কোণঠাসা হয়ে গেলে আমার বাড়ি ফেরত চলে যেতে মন চাইতো, একই নিয়মে, বাড়ির মনকেমনের সাথে সাথে , উদয় হলো ছোট ছোট শুটিং এর ইমেজ। পুরুলিয়ায় বেশ কয়েকবার সেট ফেলা হয়েছে, কখনো বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানে, এই তারকাখচিত নামের শেষের সংযোজনটা আমাকে খানিকটা জোর করেই হতে হলো, খানিকটা জোর করে।



এব্যাপারে বাবাকে অশেষ ধন্যবাদ, মনের মত ছিমছাম, দুটো "O" যুক্ত সেলুনের সন্ধান দেওয়ায় এবং আমরাও জুন মাসের একরাতে পুরুলিয়া পাড়ি দিয়েছিলাম। প্রথম ছবি, আউটডোর এবং তাও আবার জন্মভূমি হওয়ায় আনন্দ এবং চাপা উত্তেজনায় সারারাত জেগে ছিলাম, সেই সময়ে ছবির ওপেনিং শটের রদবদল ঘটে, এবং নতুন দুটো চরিত্র লিখি।বাকি রাতটা ছবির স্টোরি বোর্ড তৈরি করতে কেটে গেলো। এক্ষেত্রেও আমার একমাত্র সহযোদ্ধা ছিলো রাজদীপ, যে সময়ে অসময়ে আমাকে বারবার ঠাণ্ডা করেছে, অ্যাড্রিনালিনকে আনন্দের জন্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে এবং ছবি বানানোর নিগুঢ় সত্যের সামনাসামনি করেছে বারবার। সেটা হলো সিনেমা একটি শাশ্বত সত্য, এবং সেটে যত দুলকি চালে, মজার ছলে কাজ করতে পারবো ছবিটা এবং ছবির সাথে যুক্ত মানুষেরা কাজ ভালো করবে। শুটিং হওয়াকালীন কারণে, অকারণে আতঙ্ক ,ত্রাসের সৃষ্টি সিনেমা এবং পরিচালকের স্বাস্থের পক্ষে খারাপ, সেটা রাজদীপকে কাজ করতে দেখলে বোঝা যায়। সেলুন বানানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অন্যতম ছিলো কাঁচ। গোটা সেলুনের ভেতর কাঁচে মোড়া, খুব সাবধানে, নিদারুণ পারদর্শিতা ছাড়া সিকোয়েন্স শুট করা অসম্ভব। রাজদীপকে গোটা ছবিতে একটা কাঁচেও দেখা যায়নি।অথচ পুরো ছবিটা ও হাত দিয়ে শুট করেছে, সিনেমার ভাষায় যাকে হ্যান্ডহেল্ড শট বলে। তাই, সেলুন পুরোটাই রাজদীপের হাতে গড়া ছবি এবং আমরা এখনো প্রত্যেকটা কাজ দুজনে মিলে করি।মুদির দোকানের ফিরিস্তির মত লম্বা দল ছাড়া ছবি তৈরি করা সম্ভব, এটাও এই ছবি করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, শটে শটে। একটা ছবির জন্য লাগে ধারনা,দূরদর্শিতা আর ছবি বলার ধরণের প্রতি পূর্ব পরিকল্পনার সহজনম্যতা। একদিন পুরো ছবিটার শুটিং শেষ করে ফেলার পিছনে ছিলো অদম্য রিহার্সালের পরিশ্রম এবং প্রিপ্রোডাকশনের দক্ষতা, এর পরে এডিটিং টেবিলে  খুব একটা সসমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে ছবির শেষে বাকি সদস্যেরা সামান্য ইতস্তত করতে থাকে, তখন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তার উত্তরও ছবির বক্তব্যের মত ঋজু হয়ে উঠেছে।

প্রশ্নটা ছিলো ভয়ের জন্য রাষ্ট্র না রাষ্ট্রের জন্য ভয়? প্রথম ছবি শেষের অপেক্ষায় কিন্তু ভয় হচ্ছিলো, শেষ ও কি প্রথম ছবির অপেক্ষায়? পৃথিবীর সব সত্যি শিল্প নয় কিন্তু সব শিল্পই সত্য, বিশেষ করে সিনেমা যেটা একটা প্যারালাল রিয়েলিটি তৈরি করে। অর্থাৎ প্রতিটা রিয়েলিটি অ্যাপারেন্ট যেটা হয়ত একদিক থেকে প্যারালাল। সেভাবেই সেলুন আমারকাছে একটা প্যারালাল রিয়েলিটি, অ্যাপারেন্ট বিশ্বাস, যার কাছে অবজেক্টস আর ক্লোজার দ্যান দে অ্যাপিয়ার। ছবি করতে আসার চেয়ে ভয়ের কিছু হয় না, একটা মানুষকে প্রাণ দেওয়ার প্রসেস হচ্ছে ছবি করা। আমি যে দেশে বাস করি সে দেশে সংখ্যালঘুর সূর্মার চেয়ে কাজল অনেক শুভ, যেখানে আমরা মোল্লা আর নেড়ে বলতে বারবার ভালোবাসি। জনবসতি হয়ে যায় মোল্লা পট্টি। একজন টেনিস প্লেয়ারের ভালোবাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বর্ডার বাঁ টেনিস কোর্টের মিড লাইন, যেখানে আক আকটা সার্ভিসের বদলে আমরা আগ্রাসী রিফ্লেক্স ফিরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকি। লম্বা দাড়ি, ছাঁটা গোফকে টেনে আনি সন্দেহের ছায়ায়,আজানে বিরক্ত হই, ভজনে খুঁজে পাই ছন্দ। আমরা যেটা খুঁজি না সেটা সাহস, আমরা যেটা খুঁজে যাই সেটা নিরাপত্তা। আমরা সেফ থাকবো, সেফ মার্ক করবো, আর সেফের চেয়েও যেটা ভালো খেলবো সেটা রাজনীতি। আমি জীবনে একটা অঙ্কও ঠিক করতে পারিনি, তাই আমার ছবি পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়া সম্ভব নয়। সেলুন এমন একটা ছবি যেখানে আমার সময়টা আছে, আমাদের সময়টা আছে। আজকাল সব ছবিই দেখি পরকীয়ার, তাই আমার ছবিতে আমার দেশের পরকীয়ার গল্প। সেলুনের ধার বেশ ভালো, এদিক ওদিক হলে রক্ত বেরোতে পারে, কিন্তু এটা নতুন ব্লেডের গল্প... কাটলে কাটুক, টিটেনাসের দরকার নেই... 


1 comment: