অঙ্কের দিদিমনি
( ২ )
‘গাইড’ রিলিজ করল পঁয়ষট্টির ছয়ই ফেব্রুয়ারী । তারপর
বিপদে পড়ল দেবানন্দ । চিত্রা হলে তিনবার দেখার পর অমন হিট হিরো, ভারতীয় গ্রেগরি পেককে পাকড়ে ফেলল সদ্য কৈশোর পেরনো প্রীতিলতা । বিপদ হল
ওয়াহিদা রহমানেরও । তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে মন ঈর্ষায় ভ’রে গেল প্রীতির । তারপর অসংখ্য সিনেমা এলেও দেবানন্দ মুক্তি পেল না,
প্রীতিলতার হৃদয়ে আটকে রইল । সরলতরল হাসিখুশি মেয়েটি ছায়াছবির
রোমান্সে এত ডুবে থাকত যে, তার সঙ্গে সবসময় বসবাস করত কোনো
না কোনো স্টার । অবশ্য, বিছানা অব্দি যাবার স্বাধীনতা ছিল
একমাত্র দেবানন্দের । ভদ্রলোকের বন্দীদশা চলে উনসত্তরের সাতই নভেম্বর পর্যন্ত,
ঐ দিন মুক্তি পায় রাজেশ খান্না আর শর্মিলা ঠাকুরের ‘আরাধনা’, তারপর প্রীতি ধরে ফেলল রাজেশকে। মাঝে
ধর্মেন্দ্রর প্রবেশের সম্ভাবনা এসেছিল । বড্ড বলশালী, এই
যুক্তিতে সরিয়ে রাখা হয়। সত্তরে প্রীতির বিয়ে হয়। সেবার চারটে সিনেমা দুবার করে
দেখেছিল – জনি মেরা নাম, জীবন মৃত্যু,
মেরা নাম জোকার আর কটি পতঙ্গ। প্রথম তিনটে সে ছেঁটে ফেলে আলাদা
আলাদা কারণে। জনি মেরা নামঃ বুড়ো হয়েও দেবসাহেব খালি বাচ্চা দের সঙ্গে লটঘট করে।
জীবন মৃত্যুঃ বাংলায় আমাদের উত্তম কুমার অনেক ভালো করেছে। মেরা নাম জোকারঃ রাজ
কাপুরের গলাটা মেয়েলি, গোঁফ টা বাজে। তাছাড়া একটা সিনেমার দু’দুটো হাফটাইম ! কাটি পতঙ্গই ভাল। বেঁচে থাক রাজেশ খান্না। আশা পারেখের
পাছা বিসদৃশ, উথলে ওঠা দুধের মতো ফোলা কেন? রাজেশের টেস্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি এরকম একটা মৃদু সংশয় অবশ্য ছিল তার
মনে। সব মিলিয়ে নিজের জীবনটা কম বয়স থেকেই ছায়াছবির জগৎ বানিয়ে ফেলেছিল ভালমানুষ
মেয়েটা। নিজস্ব চিত্রনাট্যে ছবিতে দেখা চরিত্র নিয়ে কাটতো তার সময়। দিন কাটতো
গুনগুনিয়ে, রাত স্টার সংসর্গে। নতুন বর দেবপ্রসাদের সেখানে
স্থান ছিল না। বিয়ের পর হনিমুনে গেছিল দার্জিলিং। সে-ও রাজেশের জন্য। টয়ট্রেন,
ঘুম, ম্যাল, ফাইভ পয়েন্ট,
টাইগার হিল ঘোরে রাজেশের বুকে মাথা রেখে। ফার্স্ট হাফ জুড়ে গভীর
প্রেমে। হাফটাইমের পর আর ভালো লাগেনি, দুঃখী শর্মিলার জায়গায়
নিজেকে দেখতে চায়নি প্রীতি। ‘ইন্টারমিশন’ লেখা পড়তে পড়তে তার হনিমুন শেষ হয়ে যায়।
প্রথম প্রথম দেবপ্রসাদের কাছে বউয়ের খুকিপনা বেশ মজার লাগছিল, প্রশ্রয়ও দিচ্ছিল
খানিকটা। প্রশ্রয়ে যৌনতা বাড়ে। কিন্তু বিবিধ পরিবর্তনশীল স্ক্রিপ্টের সঙ্গে সে তাল
মেলাতে পারছিল না। বিয়ের নতুনত্ব কমে আসতে প্রীতির তরল তাজা ভাবটা তার অসহ্য লাগতে
থাকে। রোজ পরপুরুষের সঙ্গে কাটায় এমন বউ কোন পুরুষ সহ্য করবে? অবাস্তব এই বউ কখনো গৃহিণী হবে এই আশা দেবপ্রসাদ ছেড়ে দেয়।
আশা ছেড়ে দিয়েছিল প্রীতিলতাও। মধুচন্দ্রিমায় গিয়েই সে বুঝতে পারে বর
তার জগতের কেউ হবে না। নায়ক তো নয়ই, ভিলেন বা ছোটোখাটো সাইডরোলেও ফিট করবে না।
আগা, মেহমুদ, কিংবা মুকরিও না। সে নাহয়
মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু, ফুরফুরে একটু
রোমান্স তো থাকবে। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর দেখে ঘুমন্ত বরকে সে ডাকে, দেখো দেখো কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে, পাহাড়ে আলো গলে
পড়ছে যেন। দেবপ্রসাদ পাকা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে বাইরের দিকে তাকায়, তারপর বলে, চাঁদ এরকমই হয়...পূর্ণিমায় আলো বেশি
হয়...পাহাড়ও উঁচুনিচু হয়...এতে দেখার আছে টা কী ?তারপর পাশ
ফিরে সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতভোর একা বসে জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার বৃষ্টি দেখে প্রীতি,
দেখে ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া গাছপাথর। ভাবে বরফের মধ্যে কাঠের আগুন
জ্বেলে সে অপেক্ষায় আছে কারও। তারপর আর কখনো বরকে ডাকেনি। যা হওয়ার নয় তার পেছনে
ছুটে লাভ কী!
এইভাবে কেটে গেল পাঁচটা বছর। এর মাঝে দুটো মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।
তৃতীয়বার অতিরিক্ত সতর্কতার মধ্যে ছ’মাস কাটার পর চাঁদু ডাক্তার চেক-আপে আসে।
ছোটবেলার বড় হয়ে যাওয়া ডাক্তারবন্ধু। কথাপ্রসঙ্গে গর্ব করে দেবপ্রসাদ তাকে বলে,
বুঝলে হে, আমাদের বংশের সবার সৃষ্টি
গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে। কথাটা সত্যি। হরপ্রসাদের জন্ম ২৯ জুলাই ১৯১১।
সেদিন গোরাদের হারায় মোহনবাগান। তার দুদিন আগে থেকে ঢাকা, অসম,
পুর্ণিয়া থেকে বাঙালিরা কলকাতা ও তার আশেপাশে ভিড় জমায়। আধচেনা অনেক
আত্মীয়ে ভরে গিয়েছিল দেবপ্রসাদের পৈতৃক যৎসামান্য আস্তানা (তখনও তারা স্বচ্ছলতার
মুখ দেখেনি )। সেই প্রথম ভারতে খেলার টিকিট ব্ল্যাক হলো। মোহনবাগান শিল্ড হাতে
গ্রুপ ফটো তোলার পর প্রবল হট্টগোলের মধ্যে জন্মে যায় হরপ্রসাদ। জন্মের পাঁচমাসের
মধ্যে ব্রিটিশরা রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেয়। এভাবে নিজের, মায়ের,
বউয়ের এবং বংশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দিনক্ষণগুলো বলতে যাচ্ছিল
দেবপ্রসাদ। ডাক্তার তাকে থামায়, ‘শোনো দেবু, এভাবে দেখলে পৃথিবীর সব ঘটনাই বৃহত্তর সংকেত। সব কিছুর সঙ্গে সব কিছুর
যোগসূত্র টানা যায়। খোঁজার নেশা থাকলে খুঁজে পাবেই। ইলেকট্রিক বালব্ আবিষ্কারের
স্বর্ণ জয়ন্তী, লেনিনের মৃত্যুর একান্ন বছর, মাওয়ের লং মার্চের স্টার্টিং পয়েন্ট, কলেরার টিকার
শতবর্ষ- খুঁজলে কিছু না কিছু সবাই পাবে। এগুলো আসলে নিজদের অযোগ্যতাকে গরিমাযুক্ত
করার তৃপ্তি ’। এরই ফাঁকে পেট নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে
প্রীতি বলে, ‘ওমা, তাই তো আমাদের বিয়ে
হয়েছিল সাতই নভেম্বর, একবছর আগে ঐ দিনই তো আরাধনা রিলিজ করল।
সেই জন্যই তো আমরা টয়ট্রেনে চাপলাম, তাই না গো ’। যার উদ্দেশ্যে বলা সে বলে, ‘বোঝো কান্ড, আমি কীভাবে বেঁচে আছি বুঝেছ ডাক্তার ? ’ চা খেতে
খেতে চাঁদু বলে, ‘ছেলেমানুষ, বড্ড
ছেলেমানুষ’।
ঐতিহাসিক মুহূর্তে সৃষ্টির শর্ত মেনে সুস্মিতা হল পঁচাত্তরের বড় দিনে।
এমন সুন্দর বাচ্চা ঐ অঞ্চলের কেউ কখনো দেখেনি। দেবপ্রসাদ অবাক হয়ে গেল। আত্মীয়দের
সন্দেহ হল। পড়শিরা কানাঘুষো শুরু করলো ঈর্ষায় – সাধারণ বাড়িতে এমন সুন্দরী হয় কি ক’রে ? দেবপ্রসাদ ভাবার চেষ্টা করল কার সঙ্গে মিল আছে।
উত্তমকুমার, দেবানন্দ, ধর্মেন্দ্র না
রাজেশ খান্না। অশোককুমার, গুরু দত্ত, মনোজকুমার,
দিলীপকুমার, রাজকুমার, রাজেন্দ্রকুমার
আর সৌমিত্রকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হ’ল; তারা প্রীতির কল্পনায় ছিল না। যে যার কথা ভাবে তার জিন কি স্বপ্নেও আসে?
দেবপ্রসাদ ভেবেও কুলকিনারা করতে পারল না। শুধু এটা বুঝতে পারল,
এই বাচ্চা তার বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। না করলেও এ তারই। কিন্তু
প্রীতির কল্পনা আকাঙ্খা তাকে বড় ছোট ক’রে ফেলছে। প্রীতিলতা
অবশ্য একটুও অবাক হ’ল না। তার ভঙ্গীটা ছিল, বলার কি আছে, স্টারদের বাচ্চা তো এরকমই হয়। অন্যরকম
হওয়ার তো কথা নয়, কম সাধনা করেছি !
এরপর দেবপ্রসাদের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক খারাপ হ’তে থাকে। মা ও
মেয়ের থেকে দূরে সরতে গিয়ে আবার স্কুলজীবনের মতো নির্বান্ধব হ’য়ে পড়ে দেবপ্রসাদ। প্রীতিলতাও মনের মতো মেয়ে পেয়ে বরের পর্বটা শেষ করলো
নির্বিঘ্নে। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে। সুস্মিতা বর্ণপরিচয় ধরার
পর স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক ইশারা নির্ভর হ’য়ে পড়ে। আর, সুস্মিতা বেড়ে উঠতে থাকে মায়ের বদ্ধ
ছায়াছবির জগতের আড়ালে অনেক বেশি বেশি ক’রে ঠাকুর্দার কল্পনার
খোলা জমিতে।
বাবার মৃত্যুর পর দেবপ্রসাদ হিসেব ক’রে দেখল, এতদিন
কিছু না কিছু ক’রে চলেছে। বাকি জীবনটা আর কিছু না ক’রলেও চলবে। মাঠেঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম্পদের প্রতি মোহ দেখিয়ে লাভ নেই।
বাবার সাধের মুনিষরা উদ্ধত হ’য়ে উঠেছে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতায় জমি বেহাত হওয়ার পথে। প্রায় জলের দরে সেগুলো
সাল্টে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে এনে ফেলল সে। অকর্মণ্য বর এতকিছু পারবে ভাবেনি
প্রীতিলতা। ঐ একবারই দেখলো আলস্যের অহংকার ভেঙে তাকে কিছু করতে। পুকুরসমেত ভিন্টেজ
গাড়িটা কিনে নিল আর্মির এক রিটায়ার্ড লেফটেন্যান্ট, সিভিলিয়ানদের
শৃঙ্খলার অভাব নিয়ে কথা বলা ছিল যার একমাত্র অবসর বিনোদন। নিচের ঘরগুলোয় বসলো তিন
পরিবার ভাড়াটে। সবমিলিয়ে নিঃসঙ্গতা একটু কমল। চলাফেরার জায়গা বলতে রয়ে গেলো দোতলার
ঘরগুলো, যার দুটো নানান সময়ে মালপত্র ঠেসে বন্ধ রাখা হ’ত। খোলা আকাশবাতাসে ভ্রমণের জন্য রইল ছোট চিলেকোঠার ঘরের সামনে ছড়ানো ছাদ
আর পেছনের এক চিলতে বাগান। ততদিনে চারপাশের বাগান কেটে তৈরি হয়েছে বসতি। সবুজের
ভারসাম্য রাখতে রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তা বরাবর লাগানো হ’ল।
ইউক্যালিপ্টাসের সারি, ফাঁকে ফাঁকে ফুটে উঠলো ফল্স টালি
বসানো চিত্রবিচিত্র খোঁচাখোঁচা ঘরবাড়ি। সামনের কাঁচা রাস্তায় যখন পিচ পড়ল, যখন তিরিশ হাজার গ্যালন ক্ষমতাসম্পন্ন জলের ট্যাঙ্ক হ’ল দেবপ্রসাদের অর্ধেক চুল পেকে গেছে। প্রীতিলতা সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছে
অনেক আগেই। সে তখন মেয়ের জন্য ক্রুশে অপূর্ব লেস্ বানায়, এঁচোড়ের
আচার করে। আর, স্মৃতিকাতর আউটডোর সিকোয়েন্সের গান গুনগুন
করে। ঘরে যে আটকে যায় তার মনই বেশি দূরে ছোটে। সুস্মিতা তখন পাঁচ দুই লম্বা ক্লাস
সাড়ে নাইন। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ নির্বাক বিদেশির মতো।
স্ত্রী-কন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হ’লেও দেবপ্রসাদের বিশেষ হেলদোল হ’ল না। সে একটা ইজিচেয়ার কিনে তাতে থিতু হ’ল। মাসের
প্রথমে ব্যাঙ্কের মোটা সুদ আর তিন ভাড়াটের টাকা তোলা ছাড়া গোটা মাসটা কাটে
শুয়েবসে। কাজের লোকদের কাজ ভাগ ক’রে দেওয়া আছে , ওসব নিয়মে চলে। এই অবস্থায় সে একটা দাবা কিনে ফেলল। কাজ করা কাঠের ঘুঁটি
আর ভাঁজ করা ল্যামিনেটেড বোর্ড নিয়ে প্রৌঢ়ত্বের গোড়ায় শুরু হ’ল দাবার প্রথম পাঠ। দাবা খেলে আর পুরনো বাড়ির নানা শব্দ শোনে, শব্দের সঙ্গে পায় অদ্ভুত সব গন্ধ। অবিরাম আকাশ দেবপ্রসাদের কিছু ইন্দ্রিয়
তীক্ষ্ণ ক’রে তুলেছে। বাড়ির ছায়ার পরিবর্তন, গতির তারতম্যে ট্রেনের বগি গণনা করে চোখ বুজে। কখনও বা গল্পের বই, পুরনো খবরের কাগজ পড়ে। চাঁদু ডাক্তার একদিন বলে এটা কোনো জীবন নয়। ‘সব থাকতেও এভাবে আছ কেন ? সামান্য মান-অভিমান এত বড়
করে তোলে কেউ? টাকার জন্য না হ’লেও
নিজের জন্য কিছু করা দরকার। সংসারও করতে হয় নিজের বাঁচার জন্য। অহেতুক জটিলতায় সব
নষ্ট করছ ’। কিন্তু, আলস্যের বর্ম কঠিন,
সে আত্মরক্ষা জানে। আলস্যের গর্বে গ্যাসফানুস হয়ে ওঠা দেবপ্রসাদের
ধারণাঃ কাজে ব্যাস্তরা আসলে অকাজের লোক, ওতে পৃথিবীর উপকার
হয় না। কিছু করছি না মানে, কারও অপকার করছি না। অধিকাংশ
কুঁড়ে লোক একধরণের লোকাল দার্শনিক হয়ে পড়ে। কথাবার্তায় হয়ে ওঠে ওস্তাদ। আত্মপক্ষ
সমর্থনের জন্য গীতা থেকে নিৎশে- সব কিছুর সরল অপবাখ্যা করে চতুরভাবে। মোদ্দা কথা
একটাই- কিছু না ক’রে জীবনটা চালাব। ডাক্তার কে সে যুক্তি
দেয়ঃ এক প্রজন্ম উপার্জন করবে, পরের প্রজন্ম ভোগ করবে,
এটাই পৃথিবীর নিয়ম। বাবা প্রথমটা করেছেন, আমার
কাজ আমায় ক’রতে দাও।
- ভোগ
করার জন্যও শ্রম লাগে, সেটা অন্তত ক’র।
- পাগল
হয়েছ ডাক্তার? বাবাকে দেখেছি উদয়াস্ত খেটে মাঠের মাঝে মরে
গেল। কি হবে ওসবে?
- তবু
ওটাই জীবন। তুমি কিছুই শিখলে না। না বাবার থেকে, না বই থেকে।
মাঠে না মরে খাটে মরলে কি সুবিধা হ’ত?
- শিখেছি।
শিখেছি কোনরকম আবিষ্কার বা উপলব্ধি থেকে দূরে থাকতে হবে। সবই তো পৃথিবীতে হয়ে
গেছে। জেনেছি। লেখালিখির চক্করে একদম পড়তে নেই। লেখা যত না বুদ্ধিবিবেচনা প্রকাশ
করে তারচেয়েও বেশি প্রকাশ করে মুর্খামি। সব লেখালিখির ওপর শেষপর্যন্ত গুবরে পোকা
বসে হাসে।
- নাঃ,
তুমি একেবারে হোপলেস।
দুই বন্ধুর কথাবার্তা এইভাবে চলে। এভাবে বন্ধুত্বও বাড়ে। দুজনে একটু
দাবা খেলে। বেসুরো গলায় দেবপ্রসাদ গুনগুন করে, ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরী...’। ডাক্তার বলে, ওয়াজেদ আলী শা-র চেয়ে তোমার অবস্থা
করুণ, সবাই একদিন ছেড়ে চলে যাবে তোমায়, তোমারই জটিলতায়।
সে বছর ১১ ডিসেম্বর অকালে চলে গেল প্রীতিলতা। বিনা নোটিশে। মনে মনে সে
আগেই মরে গিয়েছিল। শরীর গেল এবার। কারণ বোঝা গেল না; বেশ রহস্যজনক। সুস্মিতা শুত মায়ের
সঙ্গে। রাতে খুব আদর কয়ার পর মেয়েকে নিজের হাতে বোনা ক্রুশের কাজের সুন্দর জামা
পরায় প্রীতি, ‘কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে’, কাজলদানি থেকে কড়ে আঙ্গুলে কপালের পাশে টিপ লাগিয়ে দেয়। তারপর খাইয়ে দাইয়ে
হাল্কা চাদর চাপা দিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। সকালে আর সে ওঠেনি। বালিশ সরাতে
পাওয়া যায় মোটাসোটা একটা ডায়েরি।
নাভি থেকে গা গুলিয়ে ওঠা দুঃখের মাঝে সেই প্রথমবারের জন্য সুস্মিতা
দেখে অপদার্থ বাবার তৎপরতা। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রোগের পুর্বলক্ষণ ছাড়া কীভাবে মা
মারা গেল বোঝা যায়নি। রহস্যের বাতাবরণের মধ্যে ডাক্তার লিখলো ‘হার্ট ফেলিওর’। পরে শোনা গেল প্রীতি নাকি এক বছর ধ’রে ইস্কিমিয়ায়
ভুগছিল। সুস্মিতার অবশ্য সন্দেহ থেকে গেল। দেবপ্রসাদ তার এত দিনের চাপা থাকা স্নেহ
উজাড় করে দিলেও তা আর কাটল না। স্ত্রীর প্রতি যে ভালোবাসা যায়নি, স্ত্রী থাকতে যে আবেগ দেখা যায়নি, দমবন্ধ করা
আধিকারবোধে তা বিপজ্জনক রূপ নিল। সুস্মিতা এই আস্বাভাবিক স্নেহ মেনে নিল না,
তার কাছে এসব বাবার আপরাধবোধের অনুতাপময় প্রকাশ। তা ছাড়া, ততদিনে অঙ্কের বই থেকে সে জেনে গেছে দুই বিন্দুর মধ্যে সংক্ষিপ্ততম
দূরত্বের পথকে সরলরেখা বলে, এবং হরপ্রসাদ আর প্রীতিলতা নামের
নামের দুই বিন্দুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল সরলরেখায়। দেবপ্রসাদ নামের বিন্দুটির
সঙ্গে দূরতম ঘুরপথের বক্ররেখাতেও সে যোগাযোগের পথ খুঁজে পায় না। তবু, বাবার দিকের আত্মীয়রা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যায়, ‘এবার
বাবার দায়িত্ব তোর’।
এসব কথাও সুস্মিতার আবঝা হয়ে এল। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রয়ে গেল মায়ের
স্মৃতি আর মোটাসোটা ডায়েরিটা। কলেজে ঢোকার পর ডায়েরিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সে।
তেমন কিছুই ছিল না। ডায়েরি যদি দিনলিপির সমাহার হয়, এটা ডায়েরি নয়। নানান বিষয়ে
এলোমেলো লেখা, সময়ের ক্রম অনুসারেও নয়। ছোটবেলার বন্ধুদের
কথা, বড় হওয়ার জায়গার বর্ণনা, আর,
অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে সিনেমার কথা। কখনও ছবির সংক্ষিপ্তসার,
কী হ’লে ভালো হ’ত সে
বিষয়ে মতামত। সমালোচকের মতো। কোন সিনেমা হলের সিটে ছারপোকা বেশি, কিংবা, কারা দর্শকদের দাবিতে একই রিল দুবার
চালিয়েছিল, এইসব কথা। স্টাররা তো ছিলই; পাহাড়ী সান্যাল, অভি ভট্টাচার্য, অসিত সেন, টুনটুন, শোভা খোটে,
মলিনা দেবী, পদ্মা দেবী, তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়েও টিপ্পনিতে ভরে উঠেছিল পাতাগুলো। সিনেমা দেখা
ছাড়ার পর শুরু হয়েছিল লেখা। এভাবেই বোধহয় ছায়ার মত ছবির জগতে টিকেছিল প্রীতিলতা।
মেয়েকে লেখা অনেক চিঠিও ছিল সেখানে। স্নেহ আর উপদেশে ভরা, সন্তান
দূর হস্টেলে থাকলে মা-রা যেমন লেখেন। তবে চমকে যাবার মতো ছিল শেষ সতেরো পাতা। হয়তো
আরও অনেক লেখার ছিল, সময় পায়নি। তাই কিছু ডট্ ডট্ ডট্ দিয়েই
কাজ সেরেছিল। এই অংশটা সাধু গদ্যে লেখা। গভীর কোনো কথা নয়, সমাজচিত্রের বড়সড়
প্রতিফলনও ছিল না সেখানে, তবু মায়ের লেখা বলে কথা!
প্রীতিলতাকে তেমন সুক্ষ অনুভুতির মানুষ বলা যাবে না, তাহলে
স্বাভাবিক চটুলতা ছেড়ে হঠাৎ সাধুগদ্যে আংশিক আত্মচরিত কেন? কে
জানে?
প্রথম দুটো পরিচ্ছদ ছিল এইরকমঃ-
প্রথম দুটো পরিচ্ছদ ছিল এইরকমঃ-
ক) “আমার বিবাহের পরবর্তী মাসে ঘোর বর্ষা আসিল। সেই প্রথম দেখিলাম জলের দাপটে
রেলগাড়ি খিড়কির পিছনে দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে। লাইন ছুঁইয়া জলের স্রোত মাটি নরম করিয়া
তোলায় মানুষের বড় বিরম্বনা হয়। পিতৃগৃহে গমনের কথা ছিল আমার। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি
তাহা বাতিল করিল। তবে, যে অঞ্চলে আমার নতুন সংসার সেটি
অত্যন্ত মনোরম স্থান। শুনিয়াছি, এই অঞ্চল ব্রিটিশবর্জিত
হওয়ায় ইহার রূপ অন্যপ্রকার ছিল। অদৃশ্য এক রেখার ঐ পার্শ্বে আসিয়া প্রতাপশালী
ইংরেজ থামিয়া যাইত। কিন্তু, আবহাওয়া দেখিতেছি সে রেখা মানিতে
চাহে না। জলমগ্ন চরাচরে আমরা সামান্য দ্বীপ হইয়া জাগিয়া আছি।”
খ) “বন্যার পূর্বাভাস সত্ত্বেও বাবা আসিলেন ছোট ভাইয়ের সহিত। আমি তাঁর আদরের
মেয়ে। স্বামী দ্বিতলের বারান্দা হইতে নামিবার সৌজন্যটুকুও দেখালেন না। উপর থেকেই
বলিলেন, এই দুর্যোগে আসিবার প্রয়োজন কি? মেয়েকে কি জলে ফেলেছেন? এক হাঁটু জলে দাঁড়াইয়া বাবা
বলিলেন, ‘বাবাজীবন আমরাই তো জলে পড়েছি’।
রাতে স্বামী বলিলেন, ‘তোমার বাবার কথা ঈঙ্গিতপুর্ণ, লক্ষণ ভালো নয়’। সে’দিনই আমি
টের পাই লক্ষণ ভালো নয়, বিবাহিত জীবন দুঃখের হইবে। তবে
শ্বশুরমশাই ভাল লোক, তিনি ক্ষুদ্র ভাবনার মানুষ নন। চমৎকার
আপ্যায়ন করিয়া আমার সম্মান রাখিলেন।”
এইভাবে আলাদা আলাদা প্রসঙ্গে লেখা। দেবানন্দ-রাজেশ-উত্তমে ডুবে থাকা
মানুষ কেন হঠাৎ কৈলাসবাসিনী দেবীর ভাষায় লিখতে শুরু করল শেষ অংশ ? সে কি জানত ‘এক্ষণ’
গৃহবধূর ডায়েরি ছাপে। সে কি বুঝতে পারেনি একদিন তা বন্ধ হ’য়ে যাবে ? তা ছাড়া, সে সব
গৃহবধূদের সেটাই ছিল স্বাভাবিক ভাষা। প্রীতিলতা অত দূর পেছনে ছুটল কেন? হয়তো সে বুঝেছিল শেষ এগিয়ে আসছে। শেষের শুরুতে মানুষ অদ্ভুত গাম্ভীর্য
অর্জন করে, অন্তত চেষ্টা করে। আর, তার
সহজতম উপায় হয়তো এমন ভাষা। প্রীতিলতাও বুঝি বা গম্ভীর কিছু বলার কথা ভেবেছিল,
যদিও সে যোগ্যতা তার ছিল না। সুস্মিতা মায়ের ডায়েরি হরপ্রসাদের সেই
ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখে। তার কেমন যেন মনে হয়, ডায়েরি মৃত্যুর
পূর্বসংকেত। দু’দুবার যা সে পেল।
(... চলবে )
No comments:
Post a Comment