পোয়েট অফ ফল
আমার দাদার ঘড়ি
ঘড়িটি দাদার নয় আসলে।
দাদা দিয়েছিলেন আমাকে। তখন সদ্য হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালে চাকুরি পেয়েছেন। আব্বার
এতদিনকার মানি ব্যাগে টাকা গুঁজে দেওয়ার পরিবর্ত এসেছে জীবনে। নতুন পেশা, নতুন শ্রম,
নতুন পারিশ্রমিক। তিনি খালি সবাইকে দিয়ে ফেলেন সঞ্চয়। সবাই জেনেও
গিয়েছিল আর কেউ না হোক, ওঁর কাছে গেলে বিমুখীন হতে হবে না।
তাদের সেই বিশ্বাসও দাদা কখনও ভেঙে ফেলবার কোশিস করেন নি। সাধ্যের বাইরে বেরিয়ে
অনিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়েও দিতে দেখেছি। আমি তখন খুব ছোট। ‘খুব’
কি? না, ‘বেশ’। আমি কথা বললেই তা শুনতে
উপদেশের মতো শোনায়। সে যা-ই বলা হৌক না কেন। যেমন-
১। আজ বাজার থেকে পুঁটি
মাছ আনা উচিত হবে না,
কেননা...
২। এই শীতে একবার মানালি
যাওয়া দরকার যেহেতু...
আমি বড় কারণ দর্শাই।
দশাসই কারণ। আমার দাদা,
সব মন দিয়ে শুনে খানিকটা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে কিঞ্চিত প্রশংসার
গুড় মাখিয়ে নিজের সিদ্ধান্তটি নিজেই নিয়ে নিতেন। তখনই আমার মন একবস্ত্রে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে যেত। একি, মশাই, এত ‘মেধা’ খরচ করে এত ‘পরিণত/বিচক্ষন/সুচিন্তিত’
মতামত পেশ করলাম তা কি সব ওইটুকু বাক্যিক স্বীকৃতির জন্য! এতে তো
হিতে বিপরীত হতে পারে। কেমন? আমি মানে উপদেশকের মনে এক ধরনের
উঁচু আধারে বসবার জন্য সব সময় আনচান করবে, ফল স্বয়ং ফলানোর
অবৈজ্ঞানিক /অযুক্তির কৃষিপণা জন্মাবে।
আমি এইভাবে স্বখাত
গাড্ডায় পড়ে যাচ্ছিলাম পারিবারিক শুভানুধ্যায়নের বাইরেই। কেউ বুঝে উঠল না আমার এই
গড়িয়ে যাওয়া। গড়াতে গড়াতে আমি যে পাতালপুরী হয়ে নাগলোকে এসে পৌঁছচ্ছি তা আন্দাজ
করার মতো সূক্ষ্মানুভূতি তখন আন্দিজে। পর্বতে। পর্বতমালায়। আমি কোনদিন পাহাড় দেখি
নি বলে গর্ব বা ভেঙে পড়ার দিন একদিন শেষ হয়ে গেল। বড়দা আমাদের পাড়া থেকে
মুকুটমণিপুর যাওয়ার অনুষ্ঠান করল। ব্যানার পড়ল--নাইট টু নাইট, মুকুটমণিপুর
যাত্রা, খরচ ৩০০ টাকা। সন্ধ্যের টিফিন- স্যান্ডউইচ, কলা, দিলখুস, চানাচুরের
প্যাকেট। ডিনারে-ভাত, ডাল, সবজি,
পনির। সকালে- বাটার টোস্ট, ডিম সেদ্ধ, কলা, জিলিপি, লাড্ডু। দুপুরে-
ভাত, মুড়ি ঘণ্ট, মুরগি কষা, কোল্ড ড্রিঙ্ক। বড়দা, বেটেকা, সহিদুলদা,
সাজাহানকাকুরা মিলে পুরো লিস্টি তৈরি করে সাজাহানকাকুর নিজের মুদি
দোকানের ওপরে টাঙিয়ে দিল।
মসজিদে যাওয়ার পথে, বাজারে যাওয়ার
পথে, দুপুর-রাতে খাওয়াদাওয়ার শেষে, সকালে
ঘুম থেকে জেগে শুধু মুকুটমণিপুর। বড়দা বলল, এত লেক দেখেছি
কিন্ত ডিমনালেকের মতো একটাও আর চোখে পড়ল না।
আমি জিগাই, সেটা কোথায় বড়দা?
-বিহারে।
-ও হ্যাঁ, ক্লাস নাইনে তুমি একবার মৌখালি স্কুল থেকে স্যারেদের সঙ্গে গেলে। দেওঘর,
রাজগির, দশম ফলস।
-মনে আছে তোর?
-আচ্ছা বড়দা,
দশম নামে হল কেন?
-আরো ন’টা এরকম আছে, ওটা হল দশ নম্বর তাই দশম মানে টেন্থ।
-কিন্ত ফলস মানে
মিথ্যা কথা, জলপ্রপাতের নাম ফলস হল কেন?
-আরে বোকা,
‘ফল’ মানে পতনও তো হয়। কত উঁচু থেকে কত জল
পড়ছে তো পড়ছে।
আমি একদিন ফলস হয়ে যাবো
কখনও ভাবি নি। শৈশবের সেই কত উচ্চতা থেকে ঘুমের মধ্যে মাথা পিছলে পড়ে যাবো এমন এক
বারুইপুরে, এমন এক ওয়েলিংটনে যার আর কোন রিসাইকেলের অবকাশ থাকবে না।
আমার বন্ধুদাদা বিখ্যাত
জ্যোতিষ। বুড়োদা বলতেন,
ওই বামনের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে। বুড়োদার বামনের মানে বনসাই মানুষ
নয়, ব্রাহ্মণ। আমরা বিশ্বাস করতাম না। না জ্যোতিষ, না বুড়োদার কথা। হাসতাম। মনে মনে কার্ল মার্ক্সের মতো ভারী দাড়িগোঁফওয়ালা
ঈষৎ গোল মুখখানা দেখি। সম্ভ্রম যে খানিক জাগে না তা নয়, তাঁর
কাজে যে খানিক হ্যাঁ-সূচিতা আসে না যে তা নয়, কিন্তু ছিল এক
মস্ত ইসলাম। সেটাই বলত, বলে, গ্রহকে নয়,
গ্রহের স্রষ্টাকে মানো। আমরা সেই সাদাপাকাচুলের ‘বামন’কে ছেড়ে অদৃশ্য-নিরাকার-রহস্যময়কে মনে মনে আঁচ
করবার চেষ্টা করতাম।
পড়াশুনোয় আমার অনীহা দেখে
বুড়োদা একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন তার জ্যোতিষবান্ধবের কাছে। তিনি একাধারে চশমারও
ডাক্তার ছিলেন। আপনারা হাসবেন, আরে, চোখের ডাক্তার হয়, চশমার হয় কী করে? হ্যাঁ যাথার্থ্য রয়েছে এই কুতুহলে,
কিন্তু সত্যি সবসময় যৌক্তিকতাকে ভিয়েতনামের মতো হারিয়েছে।
বন্ধুদাদুর কাছে নানা কিসিমের চশমা। নানা পাওয়ারের। অজস্র পাওয়ারের। আপনার চোখে
একটার পর একটা লাগিয়ে দেখবেন কোনটায় আপনি দেখে আরাম পাচ্ছেন। যাকে আপনার চোখ মেনে
নিল, সেই চশমাটিই আপনার সঙ্গী। এই হল তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি।
আমরা গেলেই তো আর তিনি
কথা শুরু করে দিতেন না। অনেক ‘পেশেন্ট’ থাকে। চশমার ফ্রেমিং করে
দেওয়ার ব্যাপার থাকে। লম্ফ জ্বালিয়ে ফ্রেম বাঁকিয়ে উপযুক্ত করা কাচের, কাচের ধার ঘষে উপযুক্ত করা ফ্রেমের--এই সব নানাবিধ বৈজ্ঞানিকতা দেখতুম
বুড়োদার পাশে বসে। বুড়োদা নিজের বন্ধুকে শুধু ভালোবাসতেন না, অনেকে শুনলে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট হবেন, তিনি তাঁকে শ্রদ্ধা
করতেন ভীষণ। তাঁদের কীভাবে আলাপ হয়েছিল সে কাহিনি শোনার আর সুযোগ হয় নি। বুড়োদা
আমাদের হাত ছেড়ে দেয়। মৌখালির ‘এল’ প্যাটার্নের
ঘরের পয়লা ঘরের মেঝেতে একদিন শেষবারের মতো মায়ের হাতে পুষ্টিভাত খেয়ে মাথা নিচু
করলেন, ওই প্রথম আর ওই শেষবারের মতো তাঁর মাথা নোয়ানো।
বুড়োদা সাদা লুঙ্গির ওপর
সাদা পাঞ্জাবি চাপিয়ে বারুইপুর আসতেন বন্ধদাদুর সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে নাতি-আমি’র ছোট হাতের কচি
আঙুল। বুড়োদার কোনদিন নাতিকে নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না। যে সাধারণত প্রশংসা করে,
সে সাধারণত প্রশ্রয় দেয় আর যে প্রশ্রয় দেয় সে দোসর হয়। আমার দোসর
আমার বুড়োদা তাঁর বামুন বন্ধুকে জিগায়, আমার নাতিটার পড়াশুনো
হবে ও ত্রিকালদর্শী?
বন্ধুদাদু শুধু মুচকি
মুচকি হাসতেন দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে। আমার জন্য ওটুকু ছিল সূর্যদয়।
ভাবতাম, নিশ্চয় পড়াশুনো আছে নাহলে বুড়োদার কথায় তিনি এমন মজা পান!
ভাবতাম, নিশ্চয় পড়াশুনো আছে নাহলে বুড়োদার কথায় তিনি এমন মজা পান!
গ্রহ,নক্ষত্র,তিথি দেখে বন্ধুদাদু বলে দিলেন, আমার দেবগণ, বৃশ্চিক রাশি। আর বুড়ো আঙুলের মাঝখানের দাগ দুটো খুঁটিয়ে মোটা চশমার ভেতর
থেকে বললেন, নাহ, ভয়ের কিছু নেই,
পড়াশুনো আমার কপালে আছে। একেবারে বঞ্চিত হব না। আমার দাদার মতো রেখার চলনগড়ন না
হলেও, পচা না। তবে, একটা ভয় রয়ে গেছে।
এই ভয়ের কথায় বুড়োদার মুখ
শুকিয়ে গেল, কী ভয় ভাই, কী ভয়?
ত্রিকালজ্ঞ বামুন জানালেন, খুব উঁচু জায়গা
থেকে পড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা জাতকের কপালে রয়েছে।
-এর উপায়?
বন্ধুদাদা আমার হাতে একটি
ডটপেন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
উঁচু জায়গা থেকে দূরে রাখবে।
সেই থেকে গাছেপালায় ওঠার
শখ আমার নষ্ট হয়ে গেল। দুটো ডাল টপকে তৃতীয় ডালে চাপবার আগেই বন্ধুদাদার শব্দবাণ
এসে আমার পায়ে বিঁধত। নেমে আসতাম। আমার পল্লিবন্ধুরা ঠাট্টা করে। জলে বাস করবে উপরন্তু
কুমীর হবে না, এ তো ব্লাসফেমি। আমি একমাত্র এই জায়গায় এমন এক ভঙ্গি দিয়ে জেতার চেষ্টা
করতাম যেন গাছে না চড়তে পারাটাই সফিস্টিকেশন। বানরত্ব থেকে মুক্তি। কেউ কেউ আমার
চাল’পোড়া খেয়ে নিত, কেউ তারপরও শ্রেষ্ঠ
ফলটা মুখে পুরে মুখ ভ্যাংচাতো। আমার খারাপ লাগত না কেননা আমি দিনের শেষে এবং
শুরুতে জীবনকে ভালোবেসেছিলাম।
ভালোবাসায় আর কাজ নাই।
আমি বড়দার কাছে অনেক গল্পগাছা শুনছি আর মুকুটমণিপুর যাওয়ার আহ্লাদের কতখানা যে
হচ্ছি তা আর কে কুড়িয়ে হিসেব করবে! বড়দা বলল, জীবনে পারলে একবার তোপচাচি যাস। আহ,
এরকম একটি হ্রদ যে বিহারে থাকবে কে ভেবেছিল।
এইসব প্রাত্যহিক আড্ডার
কোন ফাঁকে মুকুটমণিপুর যাওয়ার সন্ধ্যে চলে এলো। আমাদের পাড়ায় হুলুস্থুলু রব। সবার
আলমারি খোলার আওয়াজে পাড়া জাগরণে। সবার পারফিউমের শিস শব্দে পাড়ায় হিসহিস জেগেছে।
বড়দার দেওয়া হাতঘড়ি পরে,
জামার হাতা দু’ভাঁজ ওপরে তুলে ভ্রমণকর্তার
মেজভাই হিসেবে দায়িত্ববান সাজলাম।
মুকুটমণিপুরে পৌছে বড়দা
বলল, আমরা
ট্রেকিং করব। পাহাড়েই ট্রেকিঙের নকল মজা নেব।
বড়দা যা বলে তাতেই আমরা
দেড়শো ভাগ রাজি। হবে ট্রেকিং। চড়া হবে পাহাড়ের মাথায়। ‘দুর্গম’তম পথটা ধরেই আমরা যাবো। অর্থাৎ এখনও যেখানে পায়ের ছাপের আবছা রাস্তার
রেখা পড়ে নি, তেমন জায়গা দিয়ে। বুনো গাছের ডাল ভেঙে দু’হাতে স্কি’র মতো রাখলাম। প্রচুর প্রচুর বরফ না হোক,
ধুলো তো আছে। সেই আমাদের আইস হকি।
কয়েকটা অতি-কৌতুহলী বাঁদর
হুপহুপ করতে করতে আমাদের সঙ্গ নিল। আর দু’চারটে কুকুরের পোলাপান। আমরা তাদেরকে গাইড
মানলাম। ট্রেকিঙের নিয়ম-রেওয়াজ মেনে চলা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
তখন দুপুর। রান্নাবান্নার
লোকেরা আমাদের খোঁজাখুজি শুরু করেছে কেননা কাউকে তো বলে বেরোয় নি ট্রেকিরা। আমরা
উঠছি আর উঠছি। কত ফুট ওপরে তা মাপার মতো যন্ত্রপাতি নেই। হয়ত ৮,৮৪৮ মিটার একটু
কম। যেন ওপরে বাতাস নেই, শ্বাসকষ্টের ভান করতে লাগলাম। একটূ
সমতল দেখে আমরা প্রায় আধশোয়া হয়ে হাল্লাক দিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের এক্কেবারে
মস্তিষ্কভাগে ছড়ানো সমতল খানিকটা থাকেই।
আমি ভাবছি, আমার কি এখান
থেকে পড়ে যাওয়াই ভবিতব্য। মানে বন্ধুদাদা কি তিনকাল ঘুরে মুকুটমণিপুরের অজ্ঞাতনামা
এক পাহাড়ের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়বার দৃশ্য দেখে আমার বুড়োদাকে সাবধান করেছিলেন?
ধরো, পড়েই গেলাম। গড়ানোর তো সুযোগ তেমন নেই,
পাহাড়ের গায়ে গুল্ম ভর্তি। আটকে যাবো। তাহলে? ফলবে
কী করে তাঁর কথা? ধরলাম, গাছও আমাকে
আমাকে আটকে রাখতে পারল না, পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে নিচে পড়েই
গেলাম, আমি কখন মরব? যখন পড়ছি নাকি পড়ে
যাওয়ার পর? যদি পথে মৃত্যু হয় তাহলে পাথরে আছড়ে পড়ার
যন্ত্রণা আর হবে না, কিন্তু যদি উল্টোটা হয়!
আমি বড়দার গা ঘেঁষে
দাঁড়ালাম। বড়দা তো জানে না,
তার ভাই ওই মুহূর্তে কী ভাবছে। বড়দা বলল, আমাদের
দুইভাইয়ের একটা ছবি তোল তো ।
এরপর বিশাখাপত্তনম, ভাইজাগ, আরাকুভ্যালি, কাশ্মীর, সর্বত্র
ঘুরেছি--কিন্তু ত্রিকালদর্শীর কথা ফলে নি। কোথাও থেকে পড়ে গিয়ে বন্ধুদাদার
গ্রহনক্ষত্রজ্ঞানকে সুপ্রমাণিত করবার সৌভাগ্য হয় নি।
এরপর আমার উচ্চমাধ্যমিক
হল। কলেজে ভর্তি হলাম। আমার বড় মাসি মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর বুড়োদা অমৃতলোকে চলে
গেলেন। আমি তখন প্রথম বর্ষ,
বি এ, ইংরেজি সাম্মানিক।
ডেভিড ডেইচেস, অ্যালবার্ট-এর
হিস্টরি অফ ইংলিশ লিটেরেচর পড়ি, আব্রামের গ্লসারি অফ
লিটারারি টার্মস পড়ছি, গেবস্টান কে, বিয়েলজেবাব
কে, কার্পেডিয়াম কী, এগডান হিথ কোথায়
আর কেমন জানছি, কার্পেডিয়েম থেকে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স ও চলছে।
উঁচু জায়গা বলতে তখন শুধু
বাড়ির ছাদ। দুতলা বাড়ির ছাদ আর কতটুকু উঁচু। পড়লেও কেউ বেঁচে যেতেই পারে।
বারুইপুরে গাছে চড়ার প্রশ্নই ওঠে না। মাত্র দু’কাঠা জমিতে আমাদের বাড়ি। কোথায় গাছ আর কোথায় পতন!
এরপরও একদিন গভীর রাতে
ঘুমের মধ্যে আমি আমার সুন্দর জীবন থেকে পড়ে গেলাম। যে জীবন তারপর পেয়েছি তার চাইতে
অনেক উঁচু ছিল সে জীবন। অনেক অনেক উঁচু। ততদিনে মিলটন পড়েছি। আমার মনে হল ‘প্যারাডাইস লস্ট’
ঘটল আমার সঙ্গে। আর আমার ‘ত্রিকালদর্শী’
চশমাজ্ঞানী বন্ধুদাদা আমার মিলটন যিনি বহু আগে দেখে ফেলেছিলেন আমার
ওই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিছানার ওপরেই পড়ে যায়। উঁচু থেকে। হয়ত ৮,৮৪৮ মিটারের চাইতেও উঁচু।
খ।
ততদিনে সবাই আমার হাত
ছাড়িয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। কেউ কেউ ঠিকানা রেখে গেল, বাকিরা ‘এই আসছি’ বলে রাজ্যদেশমহাদেশ পেরিয়ে কোথায় পাড়ি
জমালো, আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তাঁদের স্মৃতিতে ধর্মাচার হল।
পাড়া খেয়ে গেল গোমাংস দিয়ে পাটনাই ভাত। পশ্চিম পুকুরের ধারে তির্পল ঘিরে বসানোর
জায়গা বানানো হল। পুকুরের পাড়ে সারি দিয়ে একজনের দাদুর মৃত্যুতে সবাই খেতে বসে
গেল। এবং রন্ধনকৌশল নিয়ে বিতন্ডাও শুরু করল। মশলার গুণাগুণ বিচার্য হল। আমি
পুকুরের জলে নিজের ছায়ার দিকে তাকাই আর দেখি আগে ওই একই জলে দুজনের ছায়া পড়ত,
আমার জ্যেঠতুতো দাদা ‘ফান’ করে বলত ‘ডুপ্লিকেট’, আজ সেই
জুড়ুয়ার সেই যমজের একজন হারিয়ে গেল, পশ্চিম পুকুরের জলে এখন
শুধু আমার একাকীত্বের ছায়া, নির্লজ্জের মতো বেঁচে থাকার
ছায়া। একজন ভাইকে, দাদাকে হারানো সহজ কথা নয়। বুড়োদা বলত,
আমরা চার ভাই। তোরা তিনজন আর আমি। আমাকে তোদের দলে নিস ভাই। আমাদের
মা’কে মেয়ে নয়, মাতৃজ্ঞানে প্রণতি
জানাত, কখনও মেহেরুন ডাক ডাকে নি, যখন
সম্বোধন করেছেন মুখে ছিল ‘মা’। বুঝতে
পারি নি তখন বুড়োদার কেন এই বয়সে একজন মায়ের দরকার। অল্পবয়সী, তরুণী, অর্ধেকেরও অর্ধেক বয়সী একজনের কাছে মাতৃত্বের
দাবি নিয়ে যাওয়া কেন? এখন তিনিই তো অভিভাবক, পিতৃতুলনীয় হয়ে সবাইকে আগলাবেন, তার বদলে এই
শিশুপনার মানেটাই বা কি? অনেক অনেক দিন গত হবার পর যখন আমার
মগজে গোঁফ গজালো তখন বুঝতে শিখলাম, বুড়োদার মা-কাঙালপনার
হেতু। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার জগতের আনাচেকানাচে, কোথাও
একটি মায়ের কল্পছায়া অনুভব করে না। ‘প্রাকৃতিক’ মা না থাকলে সে ওই মায়ের আদলকে ফেলে কিন্তু রাখতে পারে না, কোন অচেনা-আনজান নারীমুখে প্রতিষ্ঠা ক’রে পূজারম্ভ
করে। এই পূজা কিন্তু একেবারেই জবাবেলফুলপাতার পূজা নয়, এ
পূজা অতীত মা’কে, স্বর্গত মা’কে ঈষৎ জাগিয়ে তুলে তার সেই দীর্ঘ দীর্ঘ আচলের তলায় শৈশবকে খেলতে দেখবার
পূজা। এর একটাই মন্ত্র—‘মা, ‘আমি’
নয়, আমিও তোমার সন্তান।‘ নাই বা হলাম বায়োলজিকাল অপত্য তবুও আমাকে কি দলে নেবে না? বুড়োদাই আমাদের দল ভেঙে দিয়ে ‘দল’-এর ধারণাকে একই সঙ্গে জাগিয়ে ও ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেল। আমরা পুকুর ধারে বসে
সবুজ জলের নীচে ব্যঙাচির ব্যাঙ হয়ে ওঠার দলবদ্ধ প্রয়াস দেখি আর জলের ওপরে উদাসীন
ভেসে থাকা কাটা কলা গাছকেও প্রেম নিবেদন করতে ইচ্ছা হয় কেননা এই সবের মধ্যে আমার
বুড়োদা একদিন ছিলেন, বিরাজ করতেন।
বড়দা সেদিনও যথারীতি
কাঁদে নি। বাড়ির কর্তার মতো বড়বাজি-খুড়তুতো দাদুদের সঙ্গে বসে শ্রাদ্ধশ্রান্তির
প্রক্রিয়া পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করেছে। আমার আব্বা কিছু বোঝে না। না জানে হাদিস না কুর’আন। না বেহেশতি
জেওর না আশরাফ আলি থানভী। মায় ইমাম গাজালিকেও না। আব্বা শুধু সময়ে সময়ে চোখ মোছে,
আমাদের তো বুড়োদা, তার তো আব্বা। পিতা। বাবা।
ড্যাড। আমার আব্বার আব্বা। আমরা তাকে কাঁদতে দিই। এই কান্নাটুকু আটকে দিলে পাড়
ভাঙবে। আমরা মানে তার সন্তানরা সেই পাড়ে বোল্ডারের মতো কিন্তু কিছু কিছু
জলোচ্ছ্বাস হয় যা বোল্ডারকে তুলো জ্ঞান করে, ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আমি ওই নদীকে দূর থেকে দেখে কিছু বোঝবার চেষ্টা করে যাই। আজ কতগুলো কালো নৌকা তার
বুকে ভাসছে, গুনতে সচেষ্ট হই।
প্রবাসে ফিরে আসা ছাড়া আর
কোন গতি আমাদের নেই। আমার কাছে মৌখালি দেশ আর বারুইপুর প্রবাস। বারুইপুরে এসে আবার
শেক্সপিয়রীয় সনেট নিয়ে বসি। বসন্ত-গ্রীষ্ম দিনের সমর্থনে যে রূপ কবি গড়েছেন ঈশ্বর
প্রকৃতিকে হয়ত তত রূপ দেন নি। এমসিকিউ দিলে কেউ হয়ত ঈশ্বরের ইমারতের চাইতে
শেক্সপীয়রের ভুবনকে শ্রেয় ভেবে নেবে। কিন্তু মুখ্য কথা হল, বাড়িটি উপরওয়ালা
বানিয়েই রেখেছেন, একজন কবি আরেকজন ‘অ-কবি’
বা সম্ভাব্য ‘কবি’কে
কীভাবে স্বাদ নিতে হয় বাড়ির প্রতিটি কোণার, কোথায় কী
মনোরঞ্জন কারিগর ঢেকে রেখেছেন তার দিকে দৃষ্টি টেনে নিয়ে যেতে চায় মাত্র। তিনি
গাইড। প্রদর্শক। প্রকৌশলী নন।
ধীরে ধীরে সব পরত খুলে
খুলে এসে ধরা দিচ্ছিল। বড়দা শিখিয়ে দিচ্ছিল জীবন কী, কেন, কীভাবে,
কতটুকু। সব না বুঝে মাথা নেড়ে সায় দেওয়া আমার চিরকেলে অভ্যাস,
হয়ত বদ। বদভ্যাস। কিন্তু ওই মাথা নাড়াটুকু উপলব্ধির চিহ্ন নয়,
মনোযোগের চিহ্ন হিসেবে বক্তার সামনে উপস্থিত করতে চাইতাম, তার বেশি তো আমার আর কোন মেধা নেই।
একটি ফোন রোজ আসতে শুরু
করল। সেই ফোনের জন্য আমার অপেক্ষা থাকার কথা নয় এমনটা আমি চিরটাকাল ভেবে এসেছিলাম
আমার নার্সিসাস মনোগঠনের জন্য। আমি শুধু নিজের ব্রাশ নিজেই ব্যবহার করে নিজের
আলাদা কুঠুরিতে নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। এই জন্য মা বলত, সেয়ানা। কেন ‘সেয়ানা’? না, আমি সবার ছোঁয়াচ
বাঁচিয়ে চলতে চলতে সবার সঙ্গে এক দূরতিক্রম্য পর্দার আড়াল তৈরি করতে করতে এগিয়ে
চলছিলাম। অর্থাৎ সবার হয়েও আমি কারোর নয়। আমি আমার। নিজের। ঘুমুতে যাওয়ার আগে দরজা
বন্ধ করে দেয় যে তার সম্বন্ধে একান্নবর্তী পরিবারের অন্যান্যদের মন যা বলে ঠিক তাই
বলে বলে উঠছিল আমার ধর্মপ্রাণ পরিবারের। তারা চাইত আমার ঘুমের ভেতরেও আমার দরজা
হাট করে খোলা থাক। দেখা যাক, একজনের, ঘুমন্ত
জিয়ার মুখ কেমন ব্যাদান করে, তার কাঁথা বুকের ওপর কীভাবে
এলিয়ে আছে, কাঁথার ওপর খোলাবই কীভাবে ফুটফুটে ফুলের মতো ফুটে
রয়েছে সব যেন হাট হয়ে যেতে দিলে আমার যৌবনেও শৈশবভ্রমণ হয়, তা
তো আমি পারি না। আমি আগাগোড়া মা’র কথা মতো ‘সেয়ানা’।
আমি যেন ফোনটির জন্য বসে
বসে জেগে জেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি। তার সঙ্গে যেন কত কথা বলবার আছে। যদিও ফোন
শুরু হলে আঁকুশি দিয়ে কথা পেড়ে আনতে হয় এক এক করে। সে কথার স্বাদ হয় অনন্য কিন্তু
কৃত্রিমতা দোষে তাতে আবলুশ লেগে থাকে। আমি আবলুশ লাগা ছাতনা পড়া ধুতুরা রঙের কথাগুলি
সাজিয়ে তুলি। আমি সদ্য যুবার দেশে চলেছি। সেও। সেও চলেছে ওড়না উড়িয়ে মলমল করে। তার
শ্যামা গাল ফুলিয়ে, শ্যামা হাত দু’পাশে ভদ্রতার পেলব সজনে দুলিয়ে। আমার
শুভ্রতায় টান। যাহা সাদা তাহা যতই গাধা হোক, ভালো। আমার
কল্পনায় কোনকালে কালো বৌয়ের আঙুল ছিল না। কালো আঙুলের বাঁকানো ডগায় ধরা চায়ের কাপ
থেকে কখনও চিন্তায় চা খাই নি।
No comments:
Post a Comment