Wednesday, November 30, 2016

সম্পাদকের কলম


( ১ )

আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে কোহেনরা মারা যাচ্ছে, আমাদের সকালের ঘুম টাকা তুলতে পারার স্বপ্নে ভাঙছে। সমস্ত গণহত্যাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখছি আমরা। সমস্ত কিছুকে পণ্য ভাবাটা যুগধর্ম হয়ে উঠছে। এই পৃথিবী neoliberal বিশ্ব। এখানে সবকিছু বাজারের অংশ, এখানে সাফল্য ব্যক্তিনির্ভর। এই পৃথিবী একা সফল মানুষদের।
 
এই পৃথিবী আদতে কতটা কল্পনার, প্রশ্ন ওঠে। কল্পনাগুলো কতটা পণ্য তারও। ম্যাকারেলের জন্ম এমনই বিশ্বের একাকীত্বে। যেখানে কল্পনাকে পুঁজির মোড়কে বিক্রি করা স্বাভাবিক মনে করা হয়। যেখানে একটি পত্রিকা কত ভালো সেটা বোঝাতে কতজন, কত জায়গা থেকে তাতে হিটকরেছেন, সেটা মানদন্ড করা হয়। এই পৃথিবীর অনেক বাড়ির ম্যাকারেলরাই হারিয়ে গেছে।

ম্যাকারেল আদতে একটি বেড়ালের নাম। আমাদের সবার অমন একটি বেড়াল থাকে। এখন সে পুষ্যি হোক বা না হোক তার থাকাটা জরুরি। তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। আমরা মুরাকামির পাঠক না হয়েও সহজেই বুঝে নিতে পারি অস্থির সময়ে আমরা যতই বেড়ালটিকে নোরবু ওতাওয়া বলি না কেন, আসলে তার নাম ম্যাকারেল দিতেই হবে। 

এখন প্রশ্ন হলো সব ছেড়ে গদ্যের কাগজ কেন? (আমরা এটাকে কাগজই বলবো কারণ নির্মাণে এটি কাগজই. যদিও এর সাথে প্রথা মেনে জন্মানো কাগজের যোগ নেই। সেক্ষেত্রে এটি আরো বেশি কাগজ হয়ে ওঠে নির্দিষ্টতাকে ছাপিয়ে) কাগজটি এই কারণেই যাতে আমাদের মনে থাকে সুনীল-শীর্ষেন্দু ছাড়িয়েও বাংলা কথাসাহিত্যের একটি দিশা আছে। কাগজটি এই কারণেও যাতে আমাদের মনে থাকে সতীনাথ ভাদুড়ি, উদয়ন ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কমল কুমার মজুমদার, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত-রা বাংলায় লেখা-লিখি করতেন। এবং সর্বোপরি এই কারণেও যাতে আমরা নিশ্চিত হই, প্রত্যক্ষভাবে কিছু বিশেষ গোষ্ঠী বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রমাণ না করতে পারে যে বাংলা কথাসাহিত্যের ভগতিয়করণ ঘটে গেছে। আমরা এটাকে কাগজই বলবো কারণ আমরা মনে করি না কোনো কিছুকেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠিভুক্ত করা যায়।

ম্যাকারেল গদ্যের একটি তরুণ কাগজ। আমরা স্বপ্ন দেখি কিছু ভালো লেখা পড়া ও আলোচনা করার । ব্লগজিন সেক্ষেত্রে দুভাবে আমাদের উদ্দেশ্য কে সফল করে। প্রথমত, পুঁজিবাদী বিশ্বে ব্লগজিন একটি মাধ্যম (যদিও বহুলভাবে সচরাচর নয়, মানুষের অন্তর্জালের রসদের অভাবজনিত কারণে) যেখানে জ্ঞান বা আর্ট পণ্য হয়ে যাবার বাধ্যবাধকতাকে এড়াতে পারে, কিছুটা হলেও। দ্বিতীয়ত, এখানে একটি আলোচনার পরিসর পাওয়া যায়, যা কোথাও লেখক ও পাঠক এর মধ্যে একটি তাৎক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, মন্তব্য-আলোচনার মাধ্যমে। আমাদের উদ্দেশ্য আদতে মুক্ত অবস্থায় কিছু ভালো লেখা পড়া। বাংলা গদ্য সাহিত্য কবিতার তুলনায় অবহেলিত, পত্রিকা-র দিক থেকে তো বটেই। এমত অবস্থায় আমাদের ভালো লেখা পড়ার সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। আমরা আদতে এটিকে একটি যৌথ উদ্যোগ হিসেবে দেখতে চাই।

সহজভাবে বলতে গেলে আমরা কোহেনের গান শুনতে চাই। বিভিন্নভাবে। ম্যাকারেল হয়তো আমাদের সাহায্য করবে কোহেনপরবর্তী বিশ্বেও আশাবাদী থাকতে। আদতে, একটি বেড়ালের নাম নোরবু ওতাওয়া থেকে বদলে ম্যাকারেল যখন দেওয়া হয় তার পিছনে যে উদ্দেশ্য থাকে তাকেই আমরা খুঁজছি।

( ২ ) 

দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ পেয়ে গেল। ভেবে দেখলাম, আমরা বরাবর দ্বিতীয় হতে চেয়েছি। প্রথম হওয়ার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা গ্ল্যামার আমাদের ছিল না কোনদিনই। আমরা দ্বিতীয় বেঞ্চেই বসতাম। ফাইনালে হেরে রানার্স আপ হয়ে রেললাইনের ওপর বসে জয়ী ক্যাপ্টেনের সঙ্গে সেই বিকেলেই সিগারেট খেয়েছি। রাস্তা পার হয়েছি, যখন আর একজন একটু পা বাড়িয়েছে আগে। আর কেউ উড়িয়েছে ঘুড়ি, আমরা লাটাই ধরেছি। আমরা ওপেনিং করেনি। ফার্স্ট ডাউন নেমেছি। আমাদের জন্য প্রথম সংখ্যা বলে কিছু ছিলই না হয়ত। আমাদের দ্বিতীয় সংখ্যাই হয়ত শুরু।

দুঃখ একটাই, আর কোনদিনই দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ করতে পারব না।

কিভাবে যে শুরু হয় একটা পত্রিকা, আর নিভেই বা যায় কিভাবে সে এক মস্ত ব্যাপার। আস্ত থাকলে সে কথা একটু একটু করে বলা যাবে। এর মাঝে যা হয় তা প্রেম, তা বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদ।এ সব পত্রিকার কপালে লেখাই থাকে। ম্যাকারেল সল্প এক-দু মাসেই তার হাতছানি পেয়েছে।

আরও বেশ কিছু হাতছানি আমাদের দরকার। সে হাতছানি অবশ্য পাঠকের।